মাদক নয় , চাই প্রাণবন্ত তারণ্য

রাসেল: দোস্ত! একটা টান দেনা?
সজীব: না, আমি সিগারেট খাব না।
শাওন: আরে একটা টান দে, ভাল লাগবে।
এভাবে বন্ধুদের চাপে পড়ে সিগারেটে খাওয়া শুরু করে সজীব। আর একসময় সিগারেট খাওয়াটা নেশায় পরিণত হয় তার। সজীবের মত হাজারো তরুণ এভাবেই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ধুমপানে অভ্যস্ত হয়। একসময় ঝুঁকে পড়ে মাদকের দিকে। সিগারেট খাওয়া থেকেই যে মাদকাসক্ত হয় এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এক জরিপে দেখা গেছে যে, মাদকাসক্তদের ৯৮ শতাংশই ধুমপায়ী অর্থাৎ তারা মাদকাসক্ত হওয়ার আগে তারা ধুমপান করতো। তরুণ ছাত্রদের অনেকে ধুমপানকে তারুণ্যের ফ্যাশন হিসেবে দাঁড় করাতে চায়। কিন্তু গাড়ির সাইলেন্সর বা ইটের খোলার মত মানুষের মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করা কোন স্টাইল নয়। এতে কোন স্মার্টনেসও প্রকাশ পায় না।

অনেকে সিগারেট খেলে কী আর এমন হবে বলে ধুমপানের নেতিবাচক দিকটি এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, সিগারেটের নিকোটিন একটি মাদকদ্রব্য, যা হেরোইন ও কোকেনের মতো নেশাজাতীয় বস্তু। এসব বস্তু যেমন তরুণ-তরুণীদের নেশাগ্রস্তÍ করে তুলতে পারে তেমনি সিগারেটের নিকোটিনও তাদের নেশাগ্রস্ত করে তুলতে পারে।

বাংলাদেশে বর্তমানে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীই বেশি পরিমাণ মাদক গ্রহণ করে। দু দশক আগেও যেখানে বাংলাদেশের মানুষ হেরোইনের নাম জানতো না। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বোচ্চ নেশাগ্রস্ত দেশের মধ্যে সপ্তম।

বাংলাদেশে মাদকের সহজলভ্যতাই এর বিস্তারের মূল কারণ। এদেশে সহজলভ্য মাদকদ্রব্যের মধ্যে গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা ও ফেনসিডিল অন্যতম। অথচ এর একটিও এদেশে উৎপাদন হয় না। তাই মাদক সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ড্রাগ ট্রাফিকিং বা মাদক পাচার বন্ধ করা আবশ্যক।

বর্তমানে দেশে ইয়াবা নামক মাদকের বিস্তার বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘ড্রাগস ইনফরমেশন’-এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছেÑ ইয়াবা হেরোইনের চেয়েও ভয়াবহ। চিকিৎসকদের মতে, ইয়াবা সেবনের পর যেকোন সময় মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়ে যেতে পারে। যার ফলে স্ট্রোক ও রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং হৃৎপিণ্ডের গতি ও রক্তচাপ বাড়বে, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের আগমন-নির্গমন হওয়ার কারণে ফুসফুস কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে ধীরে ধীরে। আর এসব ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে মৃত্যু অবধারিত।

ইয়াবা এতই ভয়াবহ যে, ইয়াবা ছোবল থেকে সমাজকে রক্ষার জন্য থাইল্যান্ড সরকার সে দেশের গণমাধ্যমের হিসাব অনুযায়ী তিন হাজারেরও বেশি ইয়াবা বিক্রেতা ও সেবীকে ক্রসফায়ারে দেয়। এছাড়া একে সে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে গণ্য করা হয়। মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদের শাসনামলে মাদক ব্যবসায়ীদের সরাসরি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো।
বাংলাদেশে মাদকাসক্তরা বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে মাদকদ্রব্য কেনার পেছনে। দেশের সর্বোচ্ছ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন লাখ টাকার সিগারেট বিক্রি হয়। অথচ ধুমপান ও মাদকসক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তোলার জন্য কোন আন্দোলন ও আইনের বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। একটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার যে, মাদক সমস্যা শুধু বর্তমানের সমস্যা নয়, ভবিষ্যতের জন্যও সমস্যা। কিছু কিছু সমস্যা বর্তমানে সমাধান করলেই হয় না। যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে চলতে একটা সময় জাতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে পারে।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশে “মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন” করা হলেও এখনো পর্যন্ত তা পুরোপুরি কার্যকর করা হয়নি। আইনে সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি কমিটি গঠনের কথা বলা হলেও তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। পাবলিক প্লেসে ধুমপান নিষিদ্ধ করা হলেও এ আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সাধারণত মাদক দিবসকে কেন্দ্র করে মাদক নিয়ে কিছু সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু শুধু সচেতনতাই যথেষ্ট নয় মাদক নিয়ন্ত্রনের জন্য, এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও আন্দোলন।

মাদক গ্রহণ একজন তরুণের মেধা ও মননকে শেষ করে দেয়, বিনষ্ট করে তার সুপ্ত প্রতিভা ও সুস্থ চিন্তা। মাদক গ্রহণের ফলে শরীরের স্নায়ুবিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ে। মাদকদ্রব্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধন করে মস্তিস্ক ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের। মাদকাসক্ত ব্যক্তি যেমন সমাজের ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে, তেমনি একটি পরিবারকে নিঃস্ব^ করার পাশাপাশি নষ্ট করে সে পরিবারের মান-সম্মান। কোনো বাবা-মা-ই চায় না তাদের আদরের সস্তানটি মাদকসক্ত হয়ে অকালে শেষ হয়ে যাক এবং পরিবারের জন্য দুঃসহ যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে আসুক। তাই একজনন নীতিবান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আদর্শবান মানুষ  কখনোই মাদক নিতে পারে না।

একজন মানুষ  যখন মাদকাসক্ত হয় তখন সে নীতিহীন হয়ে পড়ে। এক জরিপে দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের প্রায় ৪০ শতাংশই কোনো না কোন সামাজিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো মাদকাশক্তি।

বাংলাদেশে যে হরে তরুণ ও যুব সমাজের মধ্যে মাদকাশক্তির হার বাড়ছে তা অত্যন্ত ভীতিজনক ও আশঙ্কাজনক। মাদক সমস্যা সমাধান না করলে জাতি হিসেবে আমরা অনেক পিছিয়ে যাবো। নিকট ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে যেÑএমন কোন পরিবার পাওয়া যাবে না, যে পবিরারের কেউ না কেউ মাদকাসক্ত নয়। তাই জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ও এইডসের বিস্তারের মত মাদককেও একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবেই দেখতে হবে, গ্রহণ করতে হবে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ।

সচেতন তরুণ তরুণীদের আজ এ বোধটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন “আমরা মাদকাসক্ত হয়ে অল্প বয়সেই বৃদ্ধ হয়ে যাবো না”। মাদকের বীপরীকে তরুণেরা নিজেকে বিকশিত করে দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করে গড়ে তুলবে জাতির ভবিষ্যত উজ্জ্বল সম্ভাবনা, সেটাই হোক বর্তমান সময়ের প্রত্যাশা।

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৭

Leave a Reply

Your email address will not be published.