দেশের রফতানি আয়ের অন্যতম প্রধান খাত হিসেবে স্থান করে নিতে চলেছে জাহাজ নির্মাণ শিল্প। সরবরাহের সময়সীমা ঠিক রাখায় এবং অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে মানসম্পন্ন জাহাজ নির্মাণের কারণে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ জাহাজের দিকে ঝুঁকছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলা ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে জাহাজ রফতানির কার্যাদেশ পেয়ে এখন ব্যস্ত নির্মাণ কাজে। জাহাজ রফতানি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানি এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। আগামী ছয় বছরের মধ্যে জাহাজ নির্মাণ শিল্প দেশের জিডিপির তিন শতাংশ বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শ্রমের উচ্চমূল্যের কারণে উন্নত দেশগুলো ছোট জাহাজ তৈরিতে আর আগ্রহী নয়। অথচ এই ছোট জাহাজের বিশ্ব বাজার প্রায় ৪০ হাজার কোটি ইউএস ডলারের। এর এক ভাগও যদি বাংলাদেশ ধরতে পারে, তার পরিমাণ হবে চার বিলিয়ন বা চার শ’ কোটি ডলার। ইতোমধ্যে এ খাতে দক্ষ শ্রমিক থাকার কারণে বাংলাদেশের পক্ষে এটি সম্ভব হতে পারে।
জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। যেমন, গত ২১ জুলাই আনন্দ শিপইয়ার্ড কর্তৃক নির্মিত এ যাবৎ কালের সর্ববৃহৎ জাহাজ জার্মানিতে রফতানির উদ্দেশ্যে উদ্বোধন করা হয়। নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব শিপইয়ার্ড প্রাঙ্গণে উদ্বোধন করা এ জাহাজটি ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় জার্মান ফ্ল্যাগ বহনকারী জাহাজ হিসাবে নির্মিত। একইভাবে গত ২৯ জুলাই চট্টগ্রামে অবস্থিত দেশের শীর্ষস্থানীয় জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড চারটি জাহাজ বাংলাদেশ সরকার ও জামার্নিকে সরবরাহ করেছে। তিনটি পৃথক কর্তৃপক্ষের নিকট একসঙ্গে চারটি জাহাজ হস্তান্তর বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে থাকবে।
আনন্দ শিপইয়ার্ড, হাইস্পিড গ্র“প ও ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যমত প্রধান তিনটি জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। তাদের সফলতার কারণে মেঘনা ও বসুন্ধরা গ্র“পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ শিল্পে তথা জাহাজ নির্মাণে এগিয়ে আসছে। প্রায় সাত শ’ কোটি ডলারের বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে মেঘনা শিপ বিল্ডার্স অ্যান্ড ডকইয়ার্ড লিমিটেড। কোম্পানিটি আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়ান একটি কোম্পানির সঙ্গে কারিগরি ও আনুষঙ্গিক সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ঢাকার অদূরে মেঘনা নদীর তীরে এই কোম্পানির ডকইয়ার্ড।
জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশকিছু সমস্যা মোকাবিলা করছিল। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল ব্যাংক সার্ভিস চার্জ। জাহাজ নির্মাণের জন্য বিদেশ থেকে যে কাঁচামাল নিয়ে আসা হয় সেগুলোর জন্য ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হয়। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক রেটিং অনেক কম হওয়ায় বিদেশ থেকে তারা প্রত্যাখ্যাত হয়। তখন বিদেশি কোনো ব্যাংক থেকে এ গ্যারান্টি নিতে হয়। এ গ্যারান্টি বাবদ কমিশন অনেক বেশি। জাহাজ নির্মাণ যেহেতু একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার তাই দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যাংক ঋণ নিতে হয়। অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে যেখানে সুদ দিতে হয় ৭ থেকে ৮ শতাংশ, সেখানে এ শিল্পের জন্য সুদ দিতে হয় ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ, যা উদ্যোক্তাদের জন্য বড় সমস্যা। কাঁচামাল আমদানি করার সময় ডিউটি খরচও অনেক বেশি। ১০ মিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানি করতে ৩ থেকে ৪ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এছাড়া ছাড়পত্রের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। কিন্তু সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এবং এবি ব্যাংক জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেয়া শুরু করেছে। এরফলে বেশি পরিমাণ কমিশনের বিদেশি ব্যাংকের বীপরীতে কম রেটে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো থেকে জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পাওয়ার পথ সুগম হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক আনন্দ শিপইয়ার্ডকে জাহাজ নির্মানে ঋণ দিয়েছে। এ ব্যাংকের অর্থায়নে নির্মিত জাহাজ ‘স্টেলা মুন’ ইতোমধ্যে বিদেশে রফতানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর আরও আটটি জাহাজ নির্মাণের জন্য ব্যাংক নির্ধারিত ১৩ শতাংশ ‘রেইট অব রিটার্ণ’ হারে আনন্দ শিপইয়ার্ডকে ঋণ দিয়েছে।
ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ইসলামী ব্যাংক কেন নিয়ে জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলাকে ঋণ দানে এগিয়ে এলো, এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম ইসলামী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমানের কাছে। তিনি জানান, ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশে একটি বড় ব্যাংক হিসেবে গ্রাহক সেবা দিচ্ছে। এ ব্যাংকের ঝুঁকির নেয়ার সক্ষমতা আছে। তবে জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলাকে ঋণ দেয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, আমরা মনে করি পোশাক শিল্পের মত বাংলাদেশে আরও বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ হওয়া দরকার। আমরা দেখছি যে, সাম্প্রতিককালে জাহাজ নির্মাণ শিল্প একটি বিকাশমান শিল্প হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। তাই এ শিল্পকে আরও বিকশিত করার জন্য ইসলামী ব্যাংক জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আনন্দ শিপইয়ার্ডকে ঋণ দিয়েছে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্প বিকাশেও ইসলামী ব্যাংক প্রথমদিকে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলাকে ঋণ দিয়েছিল।’
বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের দ্রুত বিকাশের জন্য দরকার এ শিল্পকে ‘অগ্রাধিকার খাত’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া। সরকারের উচিত হবে এর কাঠামোগত উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা। ইতোমধ্যে সরকার জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য বন্ডেড ওয়্যার হাউজ সুবিধা দিয়েছে, যাকে সরকারের ইতিবাচক মনোভাব বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।
গত ৫ এপ্রিল ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অফ বাংলাদেশ-আইবিএফবি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া জাহাজ শিল্পের প্রসারে জাহাজ শিল্প প্রমোশন কাউন্সিল গঠন করা হবে বলে জানান। তিনি আরও জানান, ‘জাহাজ তৈরি ও জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের জন্য নতুন নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। জাহাজ শিল্পকে গতিশীল করার জন্য শিল্প আইনও তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য আলাদা শিল্প বেল্ট গড়ে তোলা হবে এবং এ লক্ষ্যে নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে।’
বাংলাদেশি বেসরকারি ব্যাংকগুলো জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেয়ার বিষয়টি জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। একইভাবে শিল্পমন্ত্রীর এ ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত হলে জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বাড়বে এবং বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণের জন্য বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ আরও বাড়বে। এর ফলে তৈরি পোশাক শিল্পের মত জাহাজ নির্মাণ শিল্পও একটি বৃহৎ শিল্পখাত হিসেবে গড়ে ওঠবে।
রাজনৈতিক ডটকম, ১১ মার্চ ২০১১