দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানব সভ্যতার ইতিহাসে এযাবৎকাল পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। ১৯৩৯ সালে এ যুদ্ধ শুরু হয়, শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। তৎকালীন বিশ্বের প্রায় সকল পরাশক্তি এবং বেশিরভাগ রাষ্ট্রই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩০টি দেশের সব মিলিয়ে ১০ কোটিরও বেশি সামরিক সদস্য এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আমার আগের লেকচারে আমি বলেছি যে, কেন্দ্রীয় শক্তি তথা জার্মানির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। এ যুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপুরণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে জার্মানিকে কোনঠাসা করে ফেলা হয়, যা জার্মানরা কখনো মেনে নিতে পারেনি। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি তার সম্পদ, সম্মান এবং ক্ষমতার প্রায় সবটুকুই হারিয়ে বসে। এ রকম একটি অবস্থায় ১৯৩৩ সালে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানি ভার্সাই চুক্তি ভেঙে ভিতরে ভিতরে সামরিক শক্তিকে সুসজ্জিত করে তোলে। হিটলার চেয়েছিল অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে পুনরায় একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে।

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধ শুরু হয়। অল্প সময়ের মধ্যে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ দখল করে নেয় এবং যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহ আগে জার্মানি ও এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার এক চুক্তি অনুযায়ী দখলিকৃত দেশগুলো তারা ভাগ করে নেয়।

জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণের পর ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে জার্মানি ইতালির সাথে একটি মিত্রজোট গঠন করে এবং ইউরোপ মহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল নিজের দখলে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয়।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে জার্মানির কাছে ফ্রান্সের পতন ঘটে। এরপর ১৯৪১ সালে আগের সব চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করে বসে। কারণ হিটলার ভেবেছিলেন রাশিয়া অধিকার করতে পারলে সমগ্র ইউরোপ তার পদানত হবে। কিন্তু বিশাল ভু-খণ্ডের রাশিয়া আক্রমণ করা ছিল হিটলারের জীবনের সবচেয় বড় ভুল। জার্মানরা প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলে মস্কোর দিকে। রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করলেও শীত আসতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল জার্মানরা। তারা পিছু হটতে শুরু করল। এই সুযোগে রুশ গেরিলা বাহিনী আঘাত হানতে থাকে। শীত শেষ হতেই জার্মানরা নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলে। রাশিয়ার দক্ষিণে ককেশাস তেলক্ষেত্র সহ বহু অঞ্চল দখল করে দেয়। তারা রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর প্রান্তে এসে পৌঁছায় কিন্তু রুশ বাহিনীর মরণপণ সংগ্রামের মুখে শেষ পর্যন্ত জার্মানরা পরাজিত হয়।
একদিকে যখন রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ চলছে, আর অন্য দিকে বিশ্বজয়ের স্বপ্নে হিটলার আফ্রিকায় আরেকটি ফ্রন্ট খোলেন। এ সময় জাপান জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। তারা ৭ ডিসেম্বর ১৯৪১ সালে আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দরের ওপর বোমা বর্ষণ করে বন্দরটি বিধ্বস্ত করে ফেলে। এই ঘটনার ফলে আমেরিকাও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

জার্মান বাহিনীর সবচেয়ে বড় পরাজয় হলো রাশিয়ার স্টালিনগ্রাদে। দীর্ঘ ছয় মাস যুদ্ধের পর রাশিয়ান লাল ফৌজ লাল ফৌজ স্বদেশভূমি থেকে জার্মান বাহিনীকে সম্পূর্ণ উৎখাত করে ১৯৪৪ সালে একের পর এক অধিকৃত পোল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া মুক্ত করতে করে এবং জার্মানির মূল ভূখণ্ডে এসে প্রবেশ করে। অন্যদিকে ইংরেজ আর মার্কিন সৈন্যরাও জার্মানির অভিমুখে এগিয়ে চলে।
যতই চারদিক থেকে পরাজয়ের সংবাদ আসতে থাকে হিটলার উন্মত্তের মতো হয়ে ওঠেন। ১৯৪৫ সালের ২৯ এপ্রিল হিটলারের শেষ ভরসা তার স্টেইনের সৈন্যবাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তার অধিকাংশ সঙ্গীই তাকে পরিত্যাগ করে মিত্রপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠায়। হিটলার বুঝতে পারেন তার সব স্বপ্ন চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেছে। বার্লিনের প্রান্তে রুশ বাহিনীর কামানের গর্জন শোনা যাচ্ছে। হিটলার তার বারো বছরের সঙ্গিনী ইভাকে বার্লিন ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইভা তাকে পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। দুজনে সেই দিনেই বিয়ে করেন। বিয়ের পর হিটলার উপস্থিত সঙ্গীদের সাথে একসঙ্গে শ্যাম্পেন পান করেন। তারপর দুটি চিঠি লিখলেন। একটি চিঠিতে সবকিছুর জন্য ইহুদিদের অভিযুক্ত করেন। অন্য চিঠিতে নিজের সব সম্পত্তি পার্টিকে দান করেন।
৩০ এপ্রিল ১৯৪৫। চারদিক থেকে বার্লিন অবরোধ করে ফেলে লাল ফৌজ। হিটলার বুঝতে পারেন আর অপেক্ষা করা উচিত নয়। যে কোনো মুহূর্তে লাল ফৌজ এসে তাকে বন্দি করতে পারে। তিনি তার ড্রাইভার ও আরো একজনকে বললেন, মৃত্যুর পর যেন তাদের এমনভাবে পোড়ানো হয়, দেহের কোনো অংশ যেন অবশিষ্ট না থাকে। বিকেল সাড়ে তিনটার সময় তিনি নিজের ঘর থেকে বের হয়ে তার অফিসারদের সাথে করমর্দন করে নিজের ঘরে ঢোকার পরপরই গুলির শব্দ শোনা যায়। হিটলার নিজের মুখের মধ্যে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। আর এর আগেই তার সদ্য বিবাহিত বউ ইভা বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
অন্যদিকে ইতালিতে মুসোলিনিকে বন্দি করা হয় এবং ফ্যাসি বিরোধী জনগণ তাকে প্রকাশ্য রাস্তায় হত্যা করে। মিত্রশক্তি জাপানকে আত্মসমর্পণ করতে বললে জাপান তা অস্বীকার করে। তখন ৬ ও ৯ আগস্ট ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমানবিক বোমা হামলা হয়। এরপর মিত্রশক্তির কাছে জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়।

নিহতের পরিমাণ:
এই ভয়াবহ যুদ্ধে আনুমানিক ৬ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ মারা যায় যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল রাশিয়ার নাগরিক। নিহতের এই বিশাল সংখ্যার মূল কারণ ছিল গণহত্যা আর অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল:
১, এই যুদ্ধের ফলে বৃহৎ শক্তিহিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আত্মপ্রকাশ করে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশের স্থান হয় দ্বিতীয় সারিতে । ২. পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহের সমন্বয়ে গঠিত হয় ন্যাটো আর সমগ্র ইউরোপের দেশসমূহের সীমান্তরেখা নির্ধারিত হতে শুরু করে। ওয়ারস প্যাক্টের মাঝে অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহ নিয়ে দানা বেঁধে উঠে স্নায়ুযুদ্ধ। ২. জাতিসংঘ সৃষ্টি হয়। ৩. এ যুদ্ধের প্রায় শেষে পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটে। ৪. ইউরোপের পুনর্বাসনের জন্য বিশ্বব্যাংক গঠন হয়। ৫. এই যুদ্ধের পরপরই সমগ্র ইউরোপ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়; এক অংশ হয় পশ্চিম ইউরোপ আর অন্য অংশে অন্তর্ভুক্ত হয় সোভিয়েত রাশিয়া। ৬. ইতালিতে ফ্যাসিবাদী সরকারের জায়গায় প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় । জার্মানি দ্বিখন্ডিত হয়ে পূর্ব জার্মানি এবং পশ্চিম জার্মানি দুইটি দেশে বিভক্ত হয় । ৭. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্যবাদী আদর্শ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে । সর্বপ্রথম রাশিয়ার সাম্যবাদী আদর্শ জয়যুক্ত হয় । পরে চিন, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি ইত্যাদি দেশ সাম্যবাদী আদর্শ গ্রহণ করে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয় । সমাজতান্ত্রিক প্রবক্তা রূপে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট দল আত্মপ্রকাশ করে । একে কেন্দ্র করে আবার পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহ দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যায় । একদিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি এবং তাঁদের মিত্র দেশগুলি, আর অন্যদিকে রাশিয়া, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ । এর মধ্যে আবার কয়েকটি দেশ নিরপেক্ষ থেকে যায়। ভারত তার অন্যতম । এভাবে দুটি শিবিরে বিভক্ত দেশগুলির মধ্যে এক ধরণের স্নায়ুর লড়াই শুরু হয়, যার নাম ঠান্ডা যুদ্ধ । ৮. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে পরাধীন দেশগুলিতে শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতার লড়াই । সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি বুঝতে পরে যে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটতে আর দেরি নেই । দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে তারা নিজ নিজ উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা দানে তৎপর হয় । ফলে অনেক দেশ স্বাধীনতা লাভ করে, যেমন ব্রিটিশ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ায় ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জন।

২৫ এপ্রিল ২০১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published.