ট্রানজিট: বাংলাদেশের পররাষ্ট্র্রনীতি বনাম ভারতের অর্থনীতিক-মুলা

নিজের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় সামরিক উদ্যোগের পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সহজতর করতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে ভারত দীর্ঘদিন ধরে বিরামহীন কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে আসছে – সব কয়টি সরকার একইভাবে তৎপর ছিল। বাংলাদেশ এ যাবৎ সুবিধাটি দেয়নি ভারতকে, কিন্তু কেন? এর বিপরীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের অবস্থান দৃশ্যত ভিন্ন ভিন্ন ছিল। আবার কোনো সরকার এই সুবিধা দিতে আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছেন, উদ্যোগও নিয়েছিলেন, তবে সন্দেহ নেই কোনো ইতিবাচক উদ্যোগই চূড়ান্ত হয়নি এ পর্যন্ত। বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থান দিয়েই শুরু করা যাক।

বর্তমান সরকারের অবস্থান হচ্ছে- ট্রানজিট একটি ‘অর্থনৈতিক ইস্যু’। তারা বলছেন, এটা নিয়ে যারা রাজনৈতিক বিতর্ক করতে চায় তারা আসলে প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন চায় না, বরং ভোটের সুবিধা আদায়ের জন্য সস্তা রাজনীতির অংশ হিসেবে তারা ট্রানজিট প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়। যখন বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ট্রানজিটকে অর্থনৈতিক ইস্যু বলছেন, পাশাপাশি অন্য পক্ষ ভারত তখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাভের চেহারা দাঁড় করাচ্ছেন। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ট্রানজিট সুবিধা দিলে বাংলাদেশ বিরাট অংকের টাকা পাবে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢুকে প্রতিদিন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় এক হাজার ট্রাক যাবে। প্রতিটি ট্রাক যদি ট্রানজিট ফি হিসেবে এক হাজার টাকা দেয় তাহলে বছরে এই টাকার পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৬ কোটি টাকা। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ভারত অর্থ বিনিয়োগ করবে। ট্রানজিট সংশ্লিষ্ট্র কর্মসংস্থান হবে, বাংলাদেশি নাগরিকরা নিয়োগ পাবে। তাছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের সঙ্গে সরাসরি বৈধ বাণিজ্য চালু হবে এবং বাংলাদেশও এর থেকে সুবিধা নিতে পারবে।

ঢাকায় নিযুক্ত সদ্য বিগত ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, ’আমরা ট্রানজিটের ব্যাপারে আগ্রহী। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ট্রানজিট সুবিধা চালু হলে দুই দেশই আর্থিকভাবে লাভবান হবে। এতে জাতীয় নিরাপত্তা কোনোক্রমে হুমকির মুখে পড়বে না; বরং এর মাধ্যমে উভয় দেশেরই উপকৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান সুবিধাগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে দু দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির উন্নয়নে তা সময়োপযোগী ভূমিকা রাখবে।’ তিনি জানিয়েছিলেন, ভারত মনে করে, ট্রানজিট একটি নিখাদ অর্থনৈতিক ইস্যু, কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নয়। কিন্তু বাংলাদেশে কেন এটাকে রাজনৈতিক ইস্যু বানানো হয়েছে তার কারণ তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। ঠিক এ অবস্থান নিয়েই বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ট্রানজিটের পক্ষে নিজের দেশে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন। দেশটিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বাড়তি এটুকু যোগ করছেন যে, ট্রানজিট সুবিধা আদায়ে ভারত তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যই বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেÑ যে সম্ভাবনার কথা বলা ভারতের পক্ষে সঙ্গত কারণেই অসম্ভব।

আলাদা রাষ্ট্র্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথম যখন দেশটিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিলো তখন অবশ্য জনমত কোনো বিবেচ্য বিষয় ছিল না। প্রথমত, রাষ্ট্র্রের স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধে ভারতের বিশাল ভূমিকা ছিলো; দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিলো ভারতস্থ বাংলাদেশ সরকারের হাতে- যেখানে আওয়ামী লীগ-ই সরকার গঠন করেছিলো- কাজেই বাংলাদেশের জনমত তখনই কোনো আঞ্চলিক সম্পর্কের ধরনের কারণে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাবে এমন আশঙ্কা ছিলো না; তৃতীয়ত, যেহেতু আনুষ্ঠানিক শাসন কায়েমের সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই রাজনৈতিক শক্তির বদল ঘটেছিলো কাজেই ওই অস্থির এবং অল্প সময়ে ভারতের পক্ষেও ট্রানজিট সুবিধার মতো একটি দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামোগত সুবিধা আদায় করে নেয়া সম্ভব ছিলো না। পরে আওয়ামী লীগ কর্তৃক বাংলাদেশে সব রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি এবং তারও পরে দীর্ঘমেয়াদে সামরিক শাসনে ট্রানজিটের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান পাল্টে যায়। নব্বই-এর পরে বিএনপি’র নেতৃত্বে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে পরে ট্রানজিট আলোচনা কূটনৈতিক পর্যায়ে নতুনভাবে উঠে আসে। সরকারের বাইরেও নানা নীতিনির্ধারণী ফোরাম ও জনপরিসরে নানা মাত্রায় আলোচনা চলে। সরকার দৃশ্যত ‘যে কোনো ধরনের আঞ্চলিক সহযোগিতা’য় আগ্রহের ঘোষণা দেন। পাশাপাশি ট্রানজিট আলোচনার টেবিলে বাংলাদেশ অন্যান্য অমীমাংসিত ইস্যু তুলে আনে।

অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর মধ্যে আছে অভিন্ন নদী সমস্যা, সীমান্ত বিরোধ, নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা, বাণিজ্য ঘাটতি এবং সর্বোপরি নিরাপত্তা। বরাবরই ট্রানজিট সংক্রান্ত আলোচনায় অন্যান্য ইস্যু তুলে আনার বিরোধী ভারত। দেশটি ট্রানজিট টেবিলে বড়জোর বাণিজ্য ঘাটতি প্রসঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী হয়েছে। বাংলাদেশকে জানাচ্ছে- বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে কমাতে ট্রানজিট ভালো উপায় হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হচ্ছে- বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হওয়ার কারণ ভারতের অবস্থান। কিন্তু ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশকেই উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি বাড়িয়ে এবং পণ্যের ওপর ধার্যকৃত অশুল্ক বাধা তুলে দিয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে ভারতের ইতিবাচক অবস্থান দরকার, বাংলাদেশের নয়।

অন্যদিকে ট্রানজিট টেবিলে বসে বাংলাদেশ ‘নিরাপত্তা’ ইস্যু তোলে ভারতকে কূটনৈতিক ‘না’ বলার জন্য। অন্য একটি রাষ্ট্র্রের যান চলাচলের জন্য এত দীর্ঘ একটি পথ উন্মুক্ত করে রাখা রাষ্ট্র্রীয় নিরাপত্তার প্রতি মস্ত ঝুঁকি উন্মুক্ত করে রাখেÑ সন্দেহ নেই। যেমন ঝুঁকি নিতে ভারতের প্রস্তুত নয়। কখনো কখনো বাংলাদেশ প্রস্তাব নেপাল-ভূটানে ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ার প্রস্তাব করেছে। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ভারত বরাবরই তা নাকচ করেছে। ভারতকে ষাটের দশকের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে বাংলাদেশÑ পাকিস্তান তার পশ্চিম ও পূর্ব অংশের মধ্যে যোগাযোগের স্বার্থে ট্রানজিট চেয়েছিল। সেটাকে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওয়ারলাল নেহেরূ ‘একটি অদ্ভূত দেশের অদ্ভূত অবদার’ বলে মস্করা করেছিলেন। বলেছিলেন, ভারতের নিরাপত্তার প্রতি এমন ট্রানজিট হবে মারাত্মক হুমকি। বাংলাদেশ বলতে পারে যে, নেপাল আর বাংলাদেশের মাঝখানের ১৭ কিলোমিটার করিডোর ছাড়া ভারত একটি অদ্ভূত দেশই বটে। তাছাড়া ট্রানজিট সামরিক উদ্দেশ্যে যখন ব্যবহৃত হবে তখন উত্তর পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো শত্র“র তালিকায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশকেও অর্ন্তভুক্ত করবে। কাজেই বাংলাদেশ যখন রাষ্ট্র্রীয় নিরাপত্তার কথা বলে তখন ভারত ‘না’ শুনতে পায়। যদি সুবিধাটি দেয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশ একমত হয়ে নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলতো তবে তা ভিন্নতরভাবে তোলা হতো। তখন আলোচনা হতো কীভাবে যথাসম্ভব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। অবশ্য একটি রাষ্ট্র্র নিজের নিরাপত্তা ‘যথাসম্ভব’ পর্যায়ে রেখে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে কি না সেটা অনেক বড় প্রশ্ন।

এরকম আরও বেশ কিছু প্রসঙ্গ বাংলাদেশের তরফ থেকে তোলা হয়েছে যেগুলো ট্রানজিটকে সম্ভব করে তোলার আলোচনা নয়, বরং উল্টোটা। যেমন, বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহন অবকাঠামোর দুর্বলতা। বলা হয়Ñ ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের রেলপথ ও পরিবহনে ব্যবস্থা এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যাপক চাপের মুখে পড়বে। দেশের সড়ক যোগাযোগ এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। যানবাহনের বর্তমান চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সবাইকেই। এ অবস্থ’ায় ভারতের ভারি যানবাহন চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, রাস্তা মেরামত ও প্রশস্ত করতে বিশাল অঙ্কের অর্থের পাশাপাশি ফসলি জমিতেও হাত পড়বে। ব্রিজ তৈরিতে নদীর গতিপথ পাল্টাবে, গভীরতা কমবে। এছাড়া চোরাচালান বৃদ্ধি, মাদকদ্রব্য ও এইডস বিস্তারের ঝুঁকির কথা বলা হয়। দীর্ঘ ট্রানজিট পথের ক্ষেত্রে এমন ঝুঁকি স্বাভাবিক। এবং দ্বিপাক্ষিক সমন্বয়ে ঝুঁকি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা সম্ভব। একইভাবে; যোগাযোগ ও পরিবহন অবকাঠামোর দুর্বলতার ক্ষেত্রে ট্রানজিট বাড়তি চাপ হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই দুর্বলতা তো বাংলাদেশের নিজের প্রয়োজনেই দূর করা দরকার। এবং যে বাড়তি চাপ ট্রানজিটের কারণে আসবে, সেক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের প্রধানত ভারতের উদ্যোগ নেয়ার কথা। কিন্তু এটি এমন কোনো সমস্যা নয় যার কারণে ট্রানজিট চূড়ান্তভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশে ১৯৯১-৯৬ ও ২০০১-০৬ দু মেয়াদে বিএনপি সরকার এসব প্রতিবন্ধকতার কথাই অব্যাহতভাবে ট্রানজিট টেবিলে উঠিয়েছে। এর পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে; এক. এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে দেশটি আগ্রহী অংশীদার হিসেবে ভারতকে আলোচনার টেবিলে পায়নি, দুই. এটা হচ্ছে না বলার কূটনৈতিক ভাষা। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকার যখন এসব বিষয়ে কথা না বলেই তুলনামূলক অনেক বেশি ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছে তখন বহু পুরনো ওইসব ইস্যুতে ভারতের অবস্থান জানান দিচ্ছে যে, প্রথম কারণটিই খুব বেশি যথার্থ ছিল।
ভারত এ বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশকে একটি চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে ট্রানজিটের স্বার্থে যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে উন্নয়ন-সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচের কোনো অংশই দেশটি যোগান দেবে না। তাছাড়া ট্রানজিট ফি এর বিষয়ে সেখানে কিছু বলা হয়নি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যানের মতোই দেশটির যানবাহন শুধু টোল দেবেÑ চুক্তি অনুযায়ী। অর্থাৎ বাংলাদেশ যদি ট্রানজিট প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ করতে বসে তাতে করে লাভের ঘরে থাকবে শূন্য। ‘শূন্য’ লাভের বিনিময়ে আইন-শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, ও অবকাঠামোগত ঝুঁকি সর্বোপরি রাষ্ট্র্রীয় নিরাপত্তার মতো রাজনৈতিক ঝুঁকি নেবে বাংলাদেশ- যদি ভারতের ‘অর্থনৈতিক’ প্রস্তাব দেশটি গ্রহণ করে। দেশের বর্তমান সরকার যদি দরকষাকষি করে চুক্তিতে নিজেদের অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছে সত্যিকার অর্থেই এটি একটি সফল ‘অর্থনৈতিক’ ইস্যু হতে পারে- যেমনটি ভারত জোর দিয়ে বলে আসছে। কিন্তু যেমনটি আমরা আগের পর্বে দেখিয়েছিÑ ট্রানজিট ভারতের জন্য একটি নিরেট রাজনৈতিক ইস্যু। তাহলে একই ইস্যু বাংলাদেশের জন্য অ-রাজনৈতিক হয় কীভাবে?

ওখানে অবকাঠামো নির্মাণ, অর্থনৈতিক লেনদেন বৃদ্ধি, বাজার সম্প্রসারণ করে কার্যকর উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুরু করার তাগিদ ভারত অনুভব করে কেন? ভারতীয় ইউনিয়ন কি একটা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ করপোরেশন, যে সাতকন্যা রাজ্যে তার প্রকল্প জোরদার করতে চায়, এবং বাংলাদেশকে আরেকটি অর্থনৈতিক করপোরেশন বিবেচনা করে তার কাছ থেকে পরিবহন সুবিধা চাইছে। যদি তা-ই হবে, সেক্ষেত্রে ভারতের দক্ষ করপোরেট বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যেত যদি তারা বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিতে এসে অংশীদারিত্বের ব্যবসা করতো। সাত-কন্যা সংলগ্ন বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করার প্রস্তাব দিতে পারতো দেশটি। যাতে করে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ওই অঞ্চলকে সরবরাহ এলাকা করে সাত-কন্যাকে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থায় অর্ন্তভুক্ত করা যায় কার্যকরভাবে, এবং অবশ্যই ট্রানজিট ব্যবস্থার চেয়েও কম খরচে। চট্টগ্রাম বন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের ওপর থাকায়, শুধু সুবিধা ব্যবহারকারী ভোক্তা হিসেবে সাত-কন্যার অর্থনৈতিক প্রকল্প ভারতকে অনেক বেশি লাভ এনে দিতে পারতো। কিন্তু এমন প্রস্তাব দেয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব না। কারণ বাংলাদেশ-সাতকন্যা সীমান্তের অর্থনৈতিক জোনের মাধ্যমে সমরসম্ভার সরবরাহ সম্ভব না। তার চেয়ে বড়ো কারণ হলো- ভারত একটা রাষ্ট্র্র বটে। এবং রাজনৈতিক সত্ত্বা হিসেবে রাষ্ট্র্র সবসময়ই রাজনৈতিক ইস্যুতে কাজ করে। সাতকন্যায় উন্নয়নের উপস্থিতির নির্ধারক এবং নিয়ন্ত্রক হিসেবে রাষ্ট্র্রের উপস্থিতি অর্থাৎ রাজনৈতিক উপস্থিতি জরুরি।
লেখাটির প্রথম পর্বে আমরা দেখিয়েছি যে, ট্রানজিট সুবিধা ভারতের দরকার মূলতÑ রাষ্ট্র্রীয় অখণ্ডতা রক্ষার লক্ষ্যে চলমান সামরিক তৎপরতা সহজতর করা এবং পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রক্রিয়া কাক্সিক্ষত মাত্রায় শুরু করার জন্য। ‘অনুন্নত’ ও রাষ্ট্র্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে প্রায় বঞ্চিত হওয়ার কারণে ভারতীয় ইউনিয়নের এ অঞ্চলের অ-সামরিক নাগরিকরাও অসন্তোষ এবং ক্ষুব্ধ। এই অসন্তোষ ও ক্ষোভ এর ভিত্তি কি ‘অর্থনৈতিক’? যা দীর্ঘমেয়াদে ভারতের জন্য আবার সামরিক দুর্যোগ তৈরি করতে পারে। যদিও সামরিক দিক থেকে উত্তরপূর্বাঞ্চলে এখন আর কোনো ‘দুর্যোগ’ পরিস্থিতি নেই, আছে ‘দুর্ভাবনা’। ভারতের এই দুর্ভাবনা কি অর্থনৈতিক? এসব প্রশ্নের জবাব রাষ্ট্র্র হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারত দুপেক্ষরই জানা আছে-রাজনৈতিক। সুতরাং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র্র হিসেবে বাংলাদেশে নিশ্চয় তার হিসাব রাখবে যে, অন্য রাষ্ট্র্রের রাজনৈতিক দুর্ভাবনা দূর করতে কেবল তখনই অংশীদার হওয়া যায় যখন তা শেষ পর্যন্ত নিজের রাজনৈতিক দুর্ভাবনা না বাড়ায়। ফলে বাংলাদেশের মতো স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র্রের কাছ থেকে ট্রানজিট সুবিধা পেতে হলে ভারতকে অবশ্যই ইস্যুটিকে ‘রাজনৈতিক’ ইস্যু হিসেবে আলোচনার টেবিলে ওঠাতে হবে। বছরের পর বছর ধরে যেসব বিষয় ট্রানজিট-টেবিলে উঠতে দেয়া হয়নি- অভিন্ন নদী সমস্যা, সীমান্ত বিরোধ, নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা, বাণিজ্য ঘাটতি এবং সর্বোপরি নিরাপত্তাÑ নিজের স্বার্থ আদায়ে বাংলাদেশের চাপে রাখার মতো যেসব বিষয় ভারতের হাতে আছে- এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে, অর্থাত ট্রানজিটের স্বার্থ আদায়ে ওসব বিষয়ে বাংলাদেশকে চাপমুক্ত করতে হবে। তাহলে পরে খুব সম্ভবত বাংলাদেশ সীমিত পরিসরে নিরাপত্তা ঝুঁকি নিতে পারে, যদি নিরাপত্তা ইস্যুতে ভারত সহযোগিতামূলক ভূমিকা নেয়।

অবশ্য সুবিধা আদায়ে অন্য পথও নিতে পারে ভারত। বাংলাদেশ যদি তার রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ করতে ব্যর্থ হয়; যদি দেশটি ‘অর্থনৈতিক ইস্যু’তে ইতিবাচক অবস্থান নিয়ে, রাষ্ট্র্রীয় নিরাপত্তকে ঝুঁকিগ্রস্ত করে, নিজের ভূখণ্ড ভাড়া দেয়; অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ ইনকরপোরেটেড’ হতে আগ্রহী হয়- তবে ভারত বর্তমান অবস্থান থেকে সরে না এসেও ট্রানজিট সুবিধা নিতে পারে। সেক্ষেত্রে ট্রানজিটের হিসাব-নিকাশ বাংলাদেশ যাতে রাষ্ট্র্রের জায়গা থেকে রাজনৈতিকভাবে করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে ভারতকে। উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি ও আঞ্চলিক মুরব্বি হওয়ার খায়েশে বিভোর ভারত সেটি অবশ্যই করতে সচেষ্ট থাকবে। কিন্তু, বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব পাওয়া প্রধানমন্ত্রী কী করবেন? তাঁর দিল্লী সফর কি আমাদের দুর্দশা বাড়াবে না কমাবে?

চিন্তা, ২৭ ডিসেম্বর ২০০৯

Leave a Reply

Your email address will not be published.