বিদেশি কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত সুবিধা আদায়: নিরাপত্তাহীনতায় বাংলাদেশের জ্বালানি খাত

গত দেড় যুগ ধরে (১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে শুরু করে) বাংলাদেশ সরকার দেশকে ২৮টি ব্লকে বিভক্ত করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ক্রমান্বয়ে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি-আইওসি’গুলোর কাছে বিভিন্ন ব্লক ইজারা দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। বিভিন্ন সময় আইওসি’গুলোর সঙ্গে অসম চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে এবং গোপনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এরফলে তারা অতিরিক্ত অনেক সুবিধা ভোগ করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য বিভিন্ন সময় ক্ষতি বয়ে এনেছে। সর্বশেষ গত ২৬ সেপ্টেম্বর কেয়ার্ন এনার্জি ও হেলিবার্টন এ দেশ থেকে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমতি আদায় করে নিয়েছে। এই চুক্তি জ্বালানি খাতে বড় ধরনের নিরাপত্তাহীনতা এবং সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার পথ তৈরি করবে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্লকে বিদেশি তেল কোম্পানি
বর্তমানে দেশের মোট ২৮টি ব্লকের মধ্যে পিএসসির আওতায় বর্তমানে ১৪টি ব্লকে আইওসিগুলো কাজ করছে। আর ৮ এবং ১১নং ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্স কাজ করছে। পিএসসির (উৎপাদন বণ্টন চুক্তি) আওতায় ১৯৮৪ সালে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রথমবারের মতো বঙ্গোপসাগরের ৬টি ব্লক আইওসি’কে দেয়া হয়। এরপর ১৯৯১ সালে দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আইওসি’র সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ৮টি ব্লক নিয়ে চুক্তি হয়। কিন্তু আগের পিএসসিতে তেলের বিষয়টি উল্লেখ না থাকলেও গ্যাস পেলে কী হবে তা নির্ধারিত প্রথম রাউন্ডের আগে পিএসসি দলিলে নানা সংশোধনী আনা হয়। এ সময় সিলেটের একটি আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রসহ ১২, ১৩ ও ১৪নং ব্লক নিয়ে অক্সিডেন্টালের সঙ্গে চুক্তি সই করা হয়। এছাড়া সাগরের অন্যদিকে ১৫ ও ১৬নং ব্লক নিয়ে কেয়ার্ন এনার্জির সঙ্গে পিএসসি সই করা হয়। একই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ২২নং ব্লকের জন্য ইউএমসির সঙ্গে পিএসসি চুক্তি করা হয়। বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ায় এ ব্লক এখন পেট্রোবাংলার কাছে ফেরত এসেছে। এদিকে বঙ্গোপসাগরের ১৭ ও ১৮নং ব্লক নিয়ে পিএসসি চুক্তি করা হয় অকল্যান্ড-রেক্সউডের সঙ্গে। বর্তমানে এটি পরিচালনা করছে টোটাল ও তাল্লো ওয়েল পিএলসি।

১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় দফা বিডিং আহ্বান করে। এ সময়ও পিএসসি দলিলে কিছু সংশোধন করা হয়। এ সময় দ্বিতীয় দফা দরপত্র আহ্বান করে নির্বাচিত কোম্পানির সঙ্গে আরও ৪টি ব্লক নিয়ে পিএসসি সই করা হয়। এর মধ্যে ৯নং ব্লকে তাল্লো গ্যাস আবিষ্কার করেছে। কেয়ার্ন এবং শেভরন তাদের তিনটি ব্লকে কাজ শুরু করেছে। সর্বশেষ ২০০৯ সালে মডেল পিএসসি ২০০৮-এর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কনোকো ফিলিপসকে ১০ ও ১১ ও আইরিশ কোম্পানি তাল্লোকে বঙ্গোপসাগরের ৫নং ব্লক অনুসন্ধানের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

আইওসিগুলোর গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ
শেভরন, তাল্লো এবং কেয়ার্ন বর্তমানে বাংলাদেশের ৫৫ শতাংশের বেশি গ্যাস উৎপাদন করছে। এ বছরের ১৫ জুলাই এর হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোট গ্যাস উৎপাদন হয় ১৯৮ কোটি ৭১ লাখ ঘনফুট। এর মধ্যে আইওসিগুলো উৎপাদন করে ১০৪ কোটি ৩৪ লাখ ঘনফুট এবং বাকি ৯৪ কোটি ৩৭ লাখ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়েছে দেশীয় ক্ষেত্রে। তবে মোট উৎপাদিত গ্যাসের মধ্যে মার্কিন তেল কোম্পানি শেভরন এককভাবে গ্যাস উৎপাদন করছে ৪৫ শতাংশের বেশি।

মডেল পিএসসি-২০০৮ এ বিকিয়ে দেয়া হয়েছে দেশের স্বার্থ
মডেল পিএসসি ২০০৮ (নমুনা উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি) প্রণীত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ বিভিন্ন মহল থেকে এটি প্রবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাতিলের দাবি করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের মুখে অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও তা চূড়ান্ত অনুমোদন করে যেতে সাহস পায়নি। কিন্তু মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই কনোকো ফিলিপস ও তাল্লোকে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ব্লক ইজারা দেয়।

পিএসসি (উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি) বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সম্পদ ও অন্যান্য জাতীয় সম্পদ কবজা করার একটি সুদূরপ্রসারী সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প। মডেল পিএসসি-২০০৮ এর ধারা ৮.১০ এ বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক পেট্রোলিয়াম কারখানার অনুশীলন  অনুযায়ী ঠিকাদার তার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করবে। তা হলে দাঁড়াচ্ছে, আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি এখন আর শুধু উত্তোলনের কোম্পানি নেই। তারা এখন পেট্রোলিয়াম কারখানা।

মডেল পিএসসি-২০০৮ অনুুযায়ী, পেট্রোবাংলা উত্তোলিত গ্যাসের ২০%-এর বেশি দাবি করতে পারবে না। ৮০% গ্যাসের মালিকানা বিদেশি কোম্পানির। ২০% গ্যাস গভীর সমুদ্র থেকে স্থলভাগে আনার জন্য পাইপলাইন বসাতে হবে পেট্রোবাংলা বা বাংলাদেশকে। এই পাইপলাইন বসানোর যাবতীয় খরচ বহন করতে হবে পেট্রোবাংলাকে। বিদেশি কোম্পানির মালিকানার ৮০% গ্যাস তারা এলএনজি করে রফতানি করতে পারবে। এলএনজি প্ল্যান্ট গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানি নিজেরা বসাবে অথবা তৃতীয় কোনো কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হবে। পিএসসিতে স্পষ্ট করে বলা আছে, ৮০% রফতানির এলএনজি প্ল্যান্টের যাবতীয় খরচ ‘কস্ট রিকভারি’র (বিনিয়োগ উসুল)  আওতায় নিয়ে নেবে উত্তোলনকারী কোম্পানি। কিন্তু পেট্রোবাংলা ২০%-এর জন্য যে পাইপলাইন বসাবে, সেটা কী কস্ট রিকভারির (বিনিয়োগ উসুল) আওতায় পড়বে কিনা এ বিষয়ে পিএসসিতে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। এর মানে গ্যাস বিক্রির টাকায় বিদেশি কোম্পানি পুরো খরচ তুলে নেবে। আর পেট্রোবাংলাকে নিজের টাকা খরচ করে গ্যাস স্থলভাগে আনতে হবে।

এভাবে আইনের মারপ্যাঁচে পিএসসি ২০০৮ এমনভাবে করা হয়েছে যাতে পেট্রোবাংলা গ্যাস রফতানির অনুমতি দিতে বাধ্য হবে। কারণ উত্তোলিত গ্যাস দেশের স্থলভাগে আনার জন্য পাইপলাইন বসানোর যে বিপুল খরচ, তা পেট্রোবাংলা বহন করতে পারবে না। যেহেতু পাইপলাইন বসানোর এই খরচ ‘কস্ট রিকভারি’র (বিনিয়োগ উসুল) আওতায় পড়বে না, সেহেতু তৃতীয় কোনো কোম্পানিকেও পেট্রোবাংলা কাজ দিতে পারবে না। বাংলাদেশ যদি পাইপলাইন বসিয়ে গ্যাস স্থলভাগে আনতে সক্ষম না হয় তখন শতভাগ গ্যাসই রফতানির সুযোগ পেয়ে যাবে উত্তোলনকারী বিদেশি কোম্পানি। সমুদ্রে উৎপাদিত গ্যাস যদি রফতানিই হয়ে যায়, তবে এ গ্যাস দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোন ভূমিকা রাখবে না।

পিএসসি বাতিলের বিকল্প
আইওসিগুলো মূলত পিএসসির মাধ্যমেই অতিরিক্ত সুবিধা পায়, যা বাংলাদেশের জন্য বিভিন্ন সময় ক্ষতি বয়ে এনেছে। অথচ পিএসসি ছাড়াই আন্তর্জাতিক দরপত্র বা দরপত্রের ভিত্তিতে বিদেশি (যথাসম্ভব দেশীয়দের সংশ্লিষ্ট করে) ঠিকাদার নিয়োগ করা যায়। এক্ষেত্রে ঠিকাদার ব্যয় উসুলসহ তার প্রাপ্য লভ্যাংশ নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু তেল, গ্যাস বা কয়লার অংশীদার হতে পারবে না। ঠিকাদারের কারিগরি দক্ষতা, দক্ষ লোকবল, প্রযুক্তি ও প্রয়োজনে বিনিয়োগ অর্থাৎ এক ধরনের প্যাকেজ ডিল হতে পারে। যার মুল কথা হলো- দেশের যে কোন সম্পদের মালিক বিদেশিরা হতে পারবে না। নতুন কোনো উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) না করে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত দরপত্রের মাধ্যমে সাময়িকভাবে বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা যেতে পারে। পিএসসি ছাড়াই যে এটা সম্ভব তার উদাহরণ বাংলাদেশেই আছে। বর্তমানে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলিত হচ্ছে ও তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে একটি চীনা ঠিকাদারি কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি রয়েছে। চুক্তির মুল কথা হলোÑ প্রতিটন কয়লা উত্তোলনের জন্যে ঐ বিদেশি কোম্পানি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার বা টাকা পাবে। অর্থাৎ পিএসসি ছাড়াই তেল-গ্যাস ও কয়লা উত্তোলন করা খুব ভালোভাবেই সম্ভব।

আইওসিগুলো ইতোমধ্যে যেসব সুবিধা নিয়েছে
আইওসিগুলো বিভিন্ন সময় জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলাকে বিভিন্ন ধরনের চাপে ফেলেছে। দেখা গেছে, জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলাও সব সময় বিদেশি কোম্পানিগুলোর স্বার্থে কাজ করেছে। এরফলে দেখা গেছে তারা বিভিন্ন সময় অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করেছে। যেমন-
১. কাফকোর কাছে গ্যাস বিক্রি করা হয়েছে কম দামে। কিন্তু সেই গ্যাস দিয়ে তৈরি সার কেনা হয়েছে আন্তর্জাতিক চড়া দামে।
২. আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র জালালাবা লিজ দিয়ে দেয়া হলো অক্সিডেন্টালকে এবং কোনো দরপত্র ছাড়াই। এখন যেটা পরিচালনা করছে শেভরর। শেভরনের থেকে গ্যাস কিনছে পেট্রোবাংলা। আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র লিজ দেয়ার নজির পৃথিবীতে বিরল। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা ঘটেছে।
৩. শেভরনের কাছ থেকে পেট্রোবাংলা প্রতি এমসিএফ গ্যাস কিনেছে ৩.২৩ ডলার দামে। আর এই গ্যাস লাফার্জ সিমেন্টের কাছে বিক্রি করেছে ২.৮ ডলার দামে। বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি। তাও আবার বিদেশি কোম্পানির কাছে।
৪. লাফার্জ বাংলাদেশে ফ্যাক্টরি করেছে। তারা কম দামে গ্যাস পেয়েছে। আন্তর্জাতিক দামে সিমেন্ট-সার বিক্রি করে ডলার নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের কিছু শ্রমিক কাজ করা ছাড়া আর কোনো উপকার হয়নি। গ্যাসের দাম আর শ্রমিকের মজুরির হিসাব মেলালে দেখা যাবে দেশের লাখ লাখ ডলার ক্ষতি হয়েছে।

৫. বাংলাদেশে চার ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন এবং বিক্রি করে শেভরন এবং তাল্লো গত অর্থবছরে সাড়ে ১৪ শ’ কোটি টাকা লাভ করেছে। পিএসসি অনুযায়ী এ লাভের ওপর শেভরন বা তাল্লো কোন কর্পোরেট ট্যাক্স দেয়নি। তাদের পক্ষে ৩৭ শতাংশ হারে ৫৫৯ কোটি টাকার ট্যাক্স দিচ্ছে পেট্রোবাংলা। আইওসি’র চার ক্ষেত্রের বেশিরভাগ লাভের গ্যাস পেয়েও পেট্রোবাংলা লাভ করেছে দেড় শ’ থেকে ২০০ কোটি টাকার মতো। আইওসি’র কাছ থেকে গ্যাস কিনে গত বছর পেট্রোবাংলা লোকসান দিয়েছে ১৫ শ’ ৫৫ কোটি ৪৭ লাখ ৯৭ হাজার ৬৫ টাকা। এ রকম উদাহরণ আরও অনেক দেয়া যায়।

সর্বশেষ কেয়ার্ন এনার্র্জির আবদার
চুক্তি বহির্ভূত অতিরিক্ত সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে স্কটিশ তেল কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জি। গত ২৬ সেপ্টেম্বর কর্পোরেট কর আরোপ ছাড়াই কেয়ান এনার্জিকে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমতি দিয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। এ সুযোগ না দিলে কেয়ার্ন সাঙ্গু থেকে অবশিষ্ট গ্যাস উত্তোলন করবে না এবং নতুন এলাকায়ও গ্যাসকূপ খনন কাজ না করে ব্যবসা গুটিয়ে নেবে বলে হুমকি দেয়। তাই সরকার একরকম বাধ্য হয়ে চুক্তি বহির্ভূত দাবি মেনে নিচ্ছে। সরকারকে জিম্মি করে তীব্র গ্যাস সংকটকে পুঁজি করে কোম্পানিটি এ সুযোগ নিচ্ছে। এমনিতেই কেয়ার্নের স্বেচ্ছাচারিতায় ১৬নং ব্লকে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বিনিয়োগের অর্থ দ্রুত তুলে নিতে মজুদ বেশি দেখিয়ে সাঙ্গু থেকে অধিক হারে গ্যাস উত্তোলন করে কেয়ার্ন। যাতে মাত্র ১২ বছরের মধ্যে সাঙ্গু আজ মুমূর্ষুপ্রায়। এরপরও সেই কেয়ার্নকেই দেশের সম্ভাবনাময় ১০নং ব্ল¬কের মাগনামা ও হাতিয়ার গ্যাস প্রথমবারের মতো তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রির অনুমতি দিয়েছে পেট্রোবাংলা। এতে দেখা যায়, মাগনামা বা হাতিয়ায় কোন গ্যাস পাওয়া গেলে তার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ গ্যাস কেয়ার্ন তৃতীয় পক্ষকে বিক্রি করতে পারবে। এতে করে সরকারের লোকসান বাড়বে।

দেশি-বিদেশি অন্য যে কোন কোম্পানির কাছে উচ্চতর দামে গ্যাস বিক্রি করতেই তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমতি আদায় করে নিয়েছে কেয়ার্ন। এই তৃতীয় পক্ষ হতে পারে বিদেশি কোম্পানি কাফকো ও কোরীয় ইপিজেড। উচ্চমূল্যের কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসহ বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ কেয়ার্নেও কাছ থেকে গ্যাস ক্রয় করতে সক্ষম হবে না। ফলে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়বে। বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হারাবে তারা। যদি দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনে, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানের এই অংশের উৎপাদন খরচ কমপক্ষে পাঁচগুণ বাড়বে। এই বৃদ্ধির ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।

‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির’ সদস্য সচিব ড. আনু মুহাম্মদ এ প্রসঙ্গে চিন্তাকে বলেন, ‘কেয়ার্ন এনার্জিকে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমতি দেয়ার ফলে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ৭০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এই চুক্তির ফলে গ্যাস বাজারের অন্য যে কোনও পণ্যের মতো একটি পণ্যে পরিণত হবে। এতদিন পেট্রোবাংলা নির্দিষ্ট দামে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনেছে। তা নির্দিষ্ট মূল্যে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ, শিল্প, কৃষি ও গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরবরাহ করেছে। কিন্তু এই চুক্তির ফলে গ্যাসের সরবরাহ এখন সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে বিদেশি কোম্পানির দ্বারা। দাম নির্ধারণের ক্ষমতাও থাকবে তাদের হাতে।’

পিএসসি’র ধারা ১৬-তে বলা হয়েছে, হয় পেট্রোবাংলা গ্যাস কিনবে অথবা আন্তর্জাতিক কোম্পানি তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি করবে। অন্যদিকে ধারা ১০-এ বলা হয়েছে, বিদেশি কোম্পানি তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে পারে যদি পেট্রোবাংলা গ্যাস কিনতে রাজি না হয়। বাংলাদেশে এখন গ্যাসের যে সংকট তাতে পেট্রোবাংলার গ্যাস না কেনার কোন কারণ নেই। সরকারের কাছ থেকে কেয়ার্নের এ ধরনের অনুমতি আদায়ের ফলে পেট্রোবাংলাকে গ্যাস না দিয়ে কেয়ার্ন অন্য যে কোন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে পারবে, যা হবে পিএসসি বহির্ভূত।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বি.ডি. রহমতুল্লাহ সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে চিন্তাকে বলেন, ‘এই সরকার দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। গ্যাসের প্রচুর ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও কেয়ার্নকে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির সুযোগ করে দিয়েছে। এতদিন তারা বাধ্য ছিল পেট্রোবাংলার নিকট গ্যাস বিক্রি করতে। এখন তার জন্য দরজা খোলা হয়ে গেল। কেয়ার্ন এখন উচ্চমূল্যে পেট্রোবাংলাকে অফার দিবে। এই বাড়তি সুযোগ কেয়ার্নের দরকষাকষির ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিবে। চুক্তি অনুযায়ী তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি করে যে লাভ হবে তা ওপর যে কর আসবে তাও পেট্রোবাংলার আয় থেকে প্রদান করবে। অথচ পেট্রোবাংলা এখান থেকে কোন আয় করে না। এরফলে পেট্রোবাংলা আরও অচল হয়ে পড়বে।’ সরকার কেয়ার্নকে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির এমন অনুমতি দেয়ার ফলে এখন অন্য বিদেশি তেল-গ্যাস কোম্পানিও সরকারের কাছে এমন সুবিধা চাইতে পারে। এই চুক্তি তাই জ্বালানি খাতে বড় ধরনের নিরাপত্তাহীনতা এবং সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে বলেও অভিমত তাঁর।

আদায় করা যায়নি গ্যাসক্ষেত্র বিস্পোরণের ক্ষতিপূরণ
বাপেক্স ইতোমধ্যে মাত্র ৯০০ কোটি টাকা খরচ করে দশটি গ্যাসক্ষেত্র ও একটি তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। গ্যাস অনুসন্ধানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। বাপেক্সের খরচ বহুজাতিক কোম্পানির খরচের এক দশমাংশেরও কম। অন্যদিকে বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ গ্যাস নষ্ট করেছে। একটি মাগুরছড়ায়, আরেকটি টেংরাটিলায়। বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত এই কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি। এমনকি মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের জন্য শেভরন ও নাইকোর কাছ থেকে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়টি সংসদেও ওঠানো হয়নি।

আইওসি’র আধিপত্যবাদী আচরণ: অন্য দেশের নজির
অক্সিডেন্টাল, ইউনোকল, নাইকো, শেভরর, কেয়ার্ন, কনোকো ফিলিপস ও তাল্লো এ বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো সারা দুনিয়ার তেল-গ্যাস সম্পদ লুণ্ঠনের এক উন্মত্ত খেলায় নিযুক্ত বলে অনেকেই মনে করেন। আইওসি’গুলো সবসময় তাদের নিজেদের স্বার্থ দেখে। এর বড় উদাহরণ আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া। পৃথিবীর অন্যতম তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ নাইজেরিয়ার বিপুল খনিজ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বিদেশি তেল কোম্পানি দেশটিকে ধ্বংসের শেষ সীমানায় নিয়ে যাচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানির চাওয়া হলোÑ নাইজেরিয়ার সম্পদ ব্যবহার করে আলোকিত করা হবে ইউরোপ। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছে এটাই নাকি নাইজেরিয়ার জন্য মঙ্গলজনক! বিদেশি কোম্পানি তাদের দেশের সব তেল হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আজ নাইজেরিয়াকে বিদেশ থেকে তেল-গ্যাস আমদানি করতে হচ্ছে। সেখানকার জনগণ আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে পেরে উঠছে না। কোন উপায় না দেখে পাইপলাইনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের সম্পদ নিজেরাই জ্বালিয়ে দিচ্ছে।

প্রয়োজন পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সকে শক্তিশালী করা
বাংলাদেশের বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ যাতে পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করা যায় সেই আলোকেই জ্বালানি সম্পদ উত্তোলন ও বিতরণ করা দরকার। এক্ষেত্রে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এই দায়িত্ব পালন করার কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজন পেট্রোবাংলা ও তার অঙ্গ সংস্থা বাপেক্সকে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে কারিগরি সীমাবদ্ধতা যতটুকু আছে, বিশ্বমানের টেকনোক্র্যাট নিয়োগ দিয়ে সে অভাব দূর করা যায়। আন্তর্জাতিক তেল গ্যাস কোম্পানিগুলো সে কাজই করছে। আর এক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য অর্থাভাবের যে কথা বলা হয়, তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এ ক্ষেত্রের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করে ফেললে লোকসানের কোন আশঙ্কা থাকে না।

থাইল্যান্ড তার রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস কোম্পানিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে আজ তারা অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করেছে। আর বাংলাদেশ তাকিয়ে থাকে বিদেশি কোম্পানির দিকে। জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে কাজ করলে জাতীয় প্রতিষ্ঠান দ্বারাই বেশি ভালো কাজ করানো যায় এবং তাতে উৎপাদন খরচও কম হবে। এক তুলনামূলক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স যে কাজ করেছে ১০০ টাকায়, সেই একই কাজ করতে বিদেশি কোম্পানি নিয়েছে ৩৫০ টাকা। বাপেক্স তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে আইওসি’গুলোর তুলনায় কয়েকগুণ বেশি সাফল্য দেখিয়েছে। বাপেক্স প্রতি ২.৭৫টি কূপ খনন করলে ১টিতে গ্যাস পায়, এশিয়ায় গড়ে এই হার ১০টিতে ১টি। বিদেশি কোম্পানি ব্যর্থ হলেও বাপেক্স আবিষ্কার করেছে হরিপুর তেলক্ষেত্র। তারপরও আইওসি’র কাছে দেশের তেল-গ্যাস ইজারা দেয়া হয়েছে। এরফলে জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে অকেজো হয়ে পড়ছে বাপেক্স। আইওসি’কে ইজারা দেয়ায় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের নব্বই শতাংশ খরচ দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকেই। অথচ তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্সের খরচ বিদেশি কোম্পানির চেয়ে অনেক কম। সম্প্রতি বাপেক্সের কৃতিত্বে নেত্রকোনায় বর্তমান প্রমাণিত জাতীয় মজুদের প্রায় ৬০ শতাংশ অতিরিক্ত গ্যাসের মজুদের (চার থেকে সাড়ে চার টিসিএফ) সন্ধান পাওয়া গেছে। এই পরিমাণ গ্যাসের মজুদ যদি দেশের শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে গ্যাস বা বিদ্যুতের আর কোনো সংকট থাকার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপস এরই মধ্যে এই গ্যাসক্ষেত্র তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সরকারও যেন গ্যাসক্ষেত্রসহ সব জ্বালানি সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়াকেই প্রধান করণীয় বলে নির্ধারণ করেছে।

চিন্তা, ৩ অক্টোবর ২০১০

Leave a Reply

Your email address will not be published.