জ্বালানি নিরাপত্তায় কয়লা নীতি

বাংলাদেশে জ্বালানির চলমান সংকট কাটাতে কয়লা ব্যবহারের কোনো উদ্যোগ এখনো চূড়ান্ত করেনি সরকার। কয়লা উঠানোর কাজ এখন পর্যন্ত নীতিগত স্তরেই আটকে আছে। জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে। আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতার কারণে জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়ছে। কয়লা নীতি না থাকায় কয়লা উত্তোলনের জন্য কোনও কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করা যাচ্ছে না। ফলে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে না এবং বিদ্যুৎ সংকট তথা জ্বালানি সংকটে কয়লা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দেশে পাওয়া কয়লা কাজে লাগানো অতি প্রয়োজন। আর এজন্য প্রয়োজন একটি কয়লা নীতি, যেটি হবে জাতীয় জ্বালানি নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বাংলাদেশের মোট জিডিপি যদি সাত শতাংশের ওপরে নিয়ে যেতে হলে জ্বালানির প্রয়োজন অনেক বাড়বে। কমপক্ষে ছাব্বিশ ঘনফুট অতিরিক্ত গ্যাসের প্রয়োজন হবে। কিন্তু বিশেষ করে বিদ্যুৎ, সার, সিএনজি, আবাসিক জ্বালানি খাতের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার জন্য গ্যাস সংরক্ষণ করা দরকার। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য জ্বালানি বিকল্প উৎস হিসেবে কয়লার ব্যবহার বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশের কয়লার মান বিশ্বের যেকোনো কয়লার তুলনায় উৎকৃষ্ট। জার্মানি বা ভারতের কয়লার দাম যেখানে প্রতি টন ৫০ ডলার, সেখানে বাংলাদেশের কয়লার দাম ১০০ ডলার। বাংলাদেশের বিটুমিনাস কয়লার ১ টনের প্রজ্জ্বলন ক্ষমতা বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ২ টন কয়লার সমান। এই কয়লায় সালফারের পরিমাণ মাত্র ০.৫ ভাগ, যা পরিবেশের জন্য মোটেও ক্ষতিকর নয়।
উন্নতমানের এই কয়লার যথাযথ অর্থনৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দেশের শিল্পখাতের সামনে জ্বালানি সংকট ক্রমেই বাড়ছে, সেক্ষেত্রে কয়লা ওঠানোর উদ্যোগ নিতে দেরি করলে শুধু সংকটকে আরও বাড়ার সুযোগই দেয়া হবে।

বিদ্যুত উৎপাদনে কয়লা
কয়লা ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে অল্প পরিমাণ (২০০০ সালের হিসাব অনুযায়ী শতকরা ৩.৭৭ ভাগ) বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। মোট বিদ্যুত উৎপাদনের মধ্যে মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট আসে কয়লা জ্বালানি থেকে। অথচ আমেরিকায় মোট উৎপাদনের ৪৯ শতাংশ, ভারতে ৬৮ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ৭৬ শতাংশ, চীনে ৮১ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা থেকে উৎপন্ন হয়।

বাংলাদেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলো বড়পুকুরিয়ায়। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উপর ভিত্তি করে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। যদিও বছরের বেশিরভাগ সময় সে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিকল থাকায় গড়ে ১৬৫ মেগাওয়াট এর মত বিদ্যুৎ ঠিকমতো উৎপাদন হয়। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ গ্যাসের মজুত রয়েছে তা দিয়ে ২০১৫ সালের পর আর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মজুত কয়লা দিয়ে দৈনিক ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও তাতে ৫০ বছর পর্যন্ত চালানো সম্ভব হবে। এই তথ্য বলে দেয়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়াটা বাংলাদেশের জন্য কতটা দরকারি এবং যুক্তিযুক্ত।

কয়লা আমদানি করে বিদ্যুত
কয়লা উত্তোলন শুরু হওয়ার আগে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও চায়না প্রভৃতি দেশ থেকে কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা যায়। দেশের খনি থেকে উৎপাদন শুরু হলে আমদানি বন্ধ করে সে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো যাবে। সরকার চট্টগ্রাম খুলনাতে দুই হাজার ৬০০ মেঘাওয়াটের দুটি পৃথক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমদানি করা কয়লা দিয়ে কেন্দ্র দুটির চাহিদা মেটানো হবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোন কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

কয়লা আমদানি করে বিদ্যুত উৎপাদন খরচ তুলনামুলকভাবে কম। বিশ্বের অনেক দেশের চাহিদামাফিক কয়লা  নেই। তাদের বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হয়। জাপান, তাইওয়ান, কোরিয়া ইত্যাদি দেশকে প্রতি বছর প্রচুর কয়লা আমদানি করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা বিদেশ থেকে আসে। মূলত ইটভাটার জন্য আমদানি করা হয় কয়লা, যার ৮৩ ভাগই আসে অবৈধ পথে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ইন্ডিয়ান কয়লায় ১ শতাংশের অধিক সালফার থাকায় এ কয়লা আমদানী করা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। অথচ সম্প্রতি সরকার ভারত থেকে পরিবেশ দূষণকারী অধিক সালফারযুক্ত কয়লা আমদানির অনুমতি দিয়েছে। আমদানি নীতিতে এ ধরনের কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ কৃষিপ্রধান দেশে এ ধরনের কয়লা পরিবেশ বিপর্যয়ে বড় ভূমিকা রাখবে।

যে পরিমাণ কয়লা মজুদ আছে (পেট্রোবাংলার হিসাব মতে)

মোট কয়লাখনি    
১. জামালগঞ্জ, ২. বড়পুকুরিয়া, ৩. ফুলবাড়ী, ৪. খালিসাপাড়া ও ৫. দীঘিপাড়া

৫ টি
মোট কয়লা মজুদ: ২৫০ কোটি মেট্রিক টন।

খনিগুলোর ওপর একনজর

বড়পুকুরিয়া: ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত হয়। এখানে সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ ৩০ কোটি ৩০ লাখ টন। ১১৮ থেকে ৫০৯ মিটার গভীরে এ মজুদ প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে এই খনি থেকে কয়লা তোলা হচ্ছে।

ফুলবাড়ী: ১৯৯৭ সালে কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়। এই খনির গভীরতা ১৫০ থেকে ২৪০ মিটার। এখানে ১৫০ থেকে ২৪০ মিটার গভীরে ৫৭ কোটি ২০ লাখ টন কয়লা মজুদ রয়েছে।

খালাসপীর: ১৯৮৯ সালে আবিষ্কৃত হয়। এখানে ৬৮ কোটি ৫০ লাখ টন কয়লার মজুদ প্রমাণিত হয়েছে। এখানেও কয়লা রয়েছে স্বল্প গভীরতায় অর্থাৎ ২৫৭ থেকে ৪৮৩ মিটার গভীরতায় কয়লা স্তর রয়েছে।

দীঘিপাড়া: ১৯৯৪ সালে আবিষ্কৃত হয়। এখানে মজুদের পরিমাণ ৬০ কোটি টন। ৩২৮ থেকে ৪০৭ মিটার গভীরে এখানে কয়লা স্তর রয়েছে।

জামালগঞ্জ: ১৯৬২ সালে আবিষ্কৃত হয়। কয়লা মজুদের পরিমাণ ১০৫ কোটি ৩০ লাখ টন। ৬৬০ থেকে ১ হাজার ১৫৮ মিটার গভীরে এ কয়লা রয়েছে। কিন্তু কয়লা স্তরটি রয়েছে তিন হাজার ফিট নীচে। সাধারণ প্রযুক্তিতে তা উত্তোলন করা সম্ভব নয়।

কয়লা উঠানো: ভূ-গর্ভস্থ খনন পদ্ধতি না উন্মুক্ত পদ্ধতি
বাংলাদেশে কোন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে তা নিয়ে দুটি মত দেখা যায়। অনেকে বলছেন, পরিবেশের ক্ষতির দিক বিবেচনা করে সুড়ঙ্গ/ভূ-গর্ভস্থ খনন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করলে লাভের পরিমাণ বেশি হবে।

মুলত কয়লা কোন পদ্ধতিতে উত্তোলন করা হবে, তা নির্ভর করে কয়লাখনির অবস্থান, এর গভীরতা, কয়লা স্তরের পুরুত্ব, ভূতাত্ত্বিক ও হাইড্রোলজিক্যাল পরিবেশের ওপর। সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে খুব কম কয়লা উত্তোলন করা যায়। খনি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পদ্ধতিতে দশ থেকে বিশ শতাংশ উত্তোলন করা যায়। কিন্তু এতে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা সম্ভব। অন্যদিকে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে প্রায় আশি-৯০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন করা যায় ঠিকই কিন্তু দেশভেদে, অঞ্চলভেদে নানা মাত্রার ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল তথা দিনাজপুরে তিন ফসলি জমির যে প্রাধান্য রয়েছে, সেখানে কয়লা খনির স্তরের গভীরতার যে মাত্রা, পানির স্তরের যে গভীরতার মাত্রা এবং সেখানে জনগণের ঘনবসতির যে ঘনত্ব বিদ্যমান, তাতে সব মিলিয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শুধুমাত্র ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনির কারণে ভূগর্ভস্থ পানি বের করে আনলে আক্রান্ত হবে প্রায় ৩১৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা। এই প্রক্রিয়াতে ভূপৃষ্ঠের পানির স্তরও নিচে নেমে যাবে। এই কারণে মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা দু লাখ ২০ হাজারে দাঁড়াবে।

উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে প্রথমেই খনি এলাকাকে পানি শূণ্য করতে হবে, যাতে খনিগর্ভ পানিতে ডুবে না যায়। এজন্য খনির চারদিকে বিশাল বিশাল সব পাম্প মেশিন বসাতে হবে অর্থাৎ খনির গভীরে প্রবেশের আগেই পানি তুলে ফেলতে হবে। খনির প্রয়োজনে বিশাল এলাকা জুড়ে পানিশূন্য করার ফলে সাধারণ ও গভীর নলকূপ দিয়ে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাবে না। এতে কৃষির মারাত্বক ক্ষতি সাধিত হবে।

উন্মুক্ত খনি মানেই খনি এলাকার পরিবেশের বিরাট ক্ষতি সাধন। কয়লা পর্যন্ত পৌঁছাতে কোথাও কোথাও প্রায় হাজার ফুট গর্ত করতে হবে। খনির ভেতরে চলবে ডিনামাইট বিস্ফোরণ, কয়লা ভাঙার জন্য খনির ভেতরে বাইরে বসবে নানা যন্ত্রপাতি। চলবে বিশাল বিশাল ট্রাক, কয়লার ট্রেন। এসব থেকে যে শব্দ দুষণ হবে তার কিছু কুফল তো আছেই৷ বায় দূষণ ঘটবে কয়লার ধুলা-ময়লা থেকে। মাটির ওলোটপালট যেভাবে হবে তাতে মাইক্রো-অর্গানিজম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

অনেকে বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশ জার্মানি, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতেও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হয়। তাই বাংলাদেশেও এ পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। কথা হলো, জার্মানিতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা হচ্ছে তাই বাংলাদেশেও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তুলতে হবে এরকম যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ জার্মানির পরিবেশ এবং পরিস্থিতি আর বাংলাদেশের পরিবেশ এবং পরিস্থিতি এক নয়। জার্মানিতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন সম্ভব। কারণ সে দেশের কয়লা খনি এলাকায় খুব কম মানুষ বসবাস করে। তাছাড়া বসবাস করার মতো ভূমির অভাব নেই। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের খনি এলাকায় রয়েছে জনগণের ঘনবসতি, ফসলি জমির প্রাধান্য, খনির স্তরের গভীরতা এবং পানির স্তরের গভীরতা।

উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে আরেকটি যুক্তি দেখানো হয় যে, এ পদ্ধতিতে আশি থেকে নব্বই শতাংশ কয়লা উত্তোলন সম্ভব। কিন্তু এটা বুঝা দরকার যে, এ পদ্ধতিতে যে পরিমাণ কয়লা ওঠবে তার আশি ভাগ কয়লা রফতানি হয়ে যাবে। এজন্য এশিয়া এনার্জি-সহ অন্যান্য কোম্পনিগুলো উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার প্রতি জোর দিচ্ছে। কারণ তারা এতে কয়লা রফতানি করার সুযোগ পাবে এবং তাদের লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এজন্য আশি ভাগ কয়লা যদি রফতানিই হয়ে যায়, তাহলে তো তা দেশের কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

সুযোগ রয়েছে গ্যাসিফিকেশন তথা ইউসিজি প্রযুক্তি ব্যবহারের
উন্মুক্ত ও সুড়ঙ্গ এ দু পদ্ধতির বীপরীতে আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন (ইউসিজি-টঈএ) প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কয়লা উত্তোলনের সুযোগ রয়েছে। ইউসিজি প্রযুক্তির মাধ্যমে কার্বন ড্রাই অক্সাইড, হাইড্রোজেন ও মিথেন ইত্যাদি জ্বালানি ব্যবহার করে কয়লাকে প্রথমে গ্যাসে রূপান্তর করা হয়। সে গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয় বিদ্যুৎ। কয়লা উৎপাদন পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও এ পদ্ধতিতে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে পরিবেশবান্ধব। ইউসিজি পদ্ধতিতে উন্মুক্ত পদ্ধতির চেয়ে বেশি পরিমাণে কয়লা উত্তোলন করা যাবে। এত খরচও পড়ে অনেক কম। উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে খনি এলাকার মানুষ এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের যে আশঙ্কা রয়েছে, গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতি অনুসরণ করলে এ ধরনের আশঙ্কা থাকবে না। বিশ্বের প্রধান প্রধান কয়লা উৎপাদনকারী দেশগুলো বর্তমানে এ প্রযুক্তির দিকে ব্যাপকহারে ঝুঁকে পড়েছে।

১৮৬৮ সালে ইউসিজি প্রযুক্তির ধারণা সর্বপ্রথম ব্যক্ত করেন দু সহোদর জার্মানি প্রকৌশলী ওয়েরনার ও উইলহেম সিমেন্স। ১৯২৮ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) এ প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করলেও বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলন শুরু করে ১৯৩৭ সাল হতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ প্রযুক্তিতে প্রবেশ করে যথাক্রমে ১৯৭০ এর দশকে। চীন ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৬টি কয়লা ক্ষেত্রে সাফ্যল্যের ধারাবাহিকতায় ইউসিজি কেন্দ্র বসিয়ে বিদ্যুৎ, অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন উৎপাদন করছে। জাপানও এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সম্প্রতি ভারত, পাকিস্তান এবং পূর্ব ইউরোপের উইক্রেন, রোমানিয়া, এবং নিউজিল্যান্ড এ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্যে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে এবং উন্নয়নের জন্যে দ্রুত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি জামালগঞ্জের কয়লাখনি থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন (ইউসিজি-টঈএ) প্রযুক্তির মাধ্যমে কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে মার্কিন বেসরকারি কোম্পানি ‘ক্লিন কোল’। সরকার তাদের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে দেখার কথা বলেছে। ‘ক্লিন কোল’ কোম্পানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, ভিয়েতনাম, স্পেন, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বহু দেশে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।

কবে হবে চূড়ান্ত কয়লা নীতি
বিগত কয়েক সরকার চেষ্টা করেও কয়লানীতি চূড়ান্ত করতে পারেনি। খসড়ানীতি পর্যালোচনা করার জন্য কয়েকবার কমিটি করা হয়েছে। তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমান সরকার (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় এসেও প্রথমে কয়লানীতি আবার পর্যালোচনা করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

উন্মুক্ত না সুড়ঙ্গ কোন পদ্ধতিতে খনি হবে মূলত সে বিতর্কে আটকে গেছে কয়লানীতি।  এ ছাড়া বিদেশি বিশেষ কোম্পানিকে সুবিধা দেয়ার জন্য কয়েকটি জাতীয় স্বার্থবিরোধী ধারা সংযোজনই কয়লানীতি নিয়ে বিতর্কের জন্ম দেয়।

চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে প্রথম আলাদাভাবে একটি কয়লা নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। খসড়া নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয় ইনফ্রাসট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলেটেশন সেন্টারকে (ওওঋঈ)। ২০০৬ সালে সংস্থাটি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে খসড়া কয়লা নীতি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। খসড়া নীতিতে ঢালাও রফতানি ব্যবস্থার পরিবর্তন করে রফতানি সীমিত করা হয়। একই সঙ্গে আগের মাত্র ছয় শতাংশ রয়্যালিটির (সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশ) হার পরিবর্তন করে কয়লার আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে রয়্যালটির সমন্বয় করার প্রস্তাব করা হয়। এর ফলে ক্ষেত্রবিশেষে রয়্যালটির হার প্রায় ২০ শতাংশে উন্নীত হয়।

২০০৬ সালে ফুলবাড়ী কয়লা খনি এবং এশিয়া এনার্জিকে ঘিরে আন্দোলন গড়ে ওঠে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের দু শিক্ষকের কাছে খসড়া নীতিমালা পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়। তারা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে খসড়াটি পুনঃপর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। এরই মধ্যে জোট সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ২০০৭ সালে বুয়েটের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আবদুল মতিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটি পর্যালোচনা রিপোর্ট জমা দেয় ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি। রিপোর্টে বহুল বিতর্কিত খনন পদ্ধতি ও রয়্যালটি সম্পর্কে সরাসরি কোনো মতামত দেয়া হয়নি। পর্যালোচনা রিপোর্টের আলোকে উপদেষ্টা পরিষদে পেশ করা হলেও কয়লানীতি অনুমোদন পায়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়টি নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেয়।

মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার আগে কয়লানীতি চূড়ান্ত করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু এরপর দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও কয়লানীতি চূড়ান্ত হয়নি। জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিনকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। বলা হয়, এই কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় করা ‘কয়লানীতি-২০০৮’ পর্যালোচনা করে নীতি চূড়ান্ত করবে। কিন্তু কয়লানীতি আগের অবস্থায় রয়েছে। শুধুমাত্র সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে ঝুলে আছে কয়লানীতি। কবে নাগাদ কয়লানীতি চূড়ান্ত  হবে তা নির্দিষ্ট নয়।

খসড়া কয়লা নীতিতে যা আছে
সর্বশেষ প্রণীত খসড়া কয়লা নীতিতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এতে ‘কোল বাংলা’ নামে একটি কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি কয়লা উত্তোলনের সার্বিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। কয়লা উন্নয়ন তহবিল নামে একটি স্থায়ী তহবিল গঠনের কথাও বলা হয়েছে এতে। কয়লা নীতিতে বলা হয়েছে, বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন হলে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জয়েন্টভেঞ্চার করা যাবে। এতে পরীক্ষামূলক উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের খনি অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হাইড্রো-জিওলজিক্যাল অবস্থার কারণে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তর দিকে পরীক্ষামূলকভাবে একটি উন্মুক্ত কয়লার খনি বাস্তবায়ন করা যাবে। সন্তোষজনকভাবে উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ভবিষ্যতে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন করা যাবে।

খসড়া নীতিতে কয়লা রফতানির কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। তবে উন্নতমানের ‘কোকিং কয়লা’ থেকে কোক তৈরি করে তা রফতানি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ, দেশে এ কয়লা ব্যবহারের সুযোগ নেই। এতে বলা হয়েছে, কয়লা খনির রয়্যালটি সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার রয়্যালটির হার নির্ধারণ করবে। সরকার কয়লা খনিভেদে রয়্যালটি নির্ধারণ করবে। তবে ‘খনি বাংলা’ কয়লা ক্ষেত্র উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করলে এবং সরকারি মালিকানা বা যৌথ মালিকানায় কয়লা তোলা হলে তা রয়্যালটির পরিবর্তে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হতে পারে। খনি উন্নয়নকারীকে খনিমুখে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। সার উৎপাদন ও সিএনজি ছাড়া সব ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে গ্যাসের পরিবর্তে কয়লার ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ কয়লা নীতিতে খনি এলাকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে এবং পরিবেশের ওপর সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া পরিবেশ অধিদফতর তার আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

খসড়া কয়লানীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কয়লা নীতিতে বেশকিছু ভালো দিক রয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার যে ধারা রয়েছে তা একটি ভালো প্রস্তাব। এজন্য কয়লা রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখে তা দ্রুত অনুমোদন পাওয়া উচিত।

চিন্তা, ৫ আগস্ট ২০১০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *