ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও কিছু প্রশ্ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ৮৮ বছর অতিক্রান্ত করেছে। এই বয়সে মানবদেহ যেমনিভাবে নানা রোগে ভোগে, ক্ষয়ে যায় জীবনীশক্তি ঠিক তেমন অবস্থা যেন আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও। স্বাধীনতার পর থেকে যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তার মনের মতো চলতে চলতে প্রায় স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে একদা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

২৬০.৫০ একর জমির ওপর অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৯টি অনুষদ, ৫৬টি বিভাগ ও ৯টি ইনষ্টিটিউট রয়েছে। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০,৯৭০। অনেকের মতে, এখন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া মান আগের মত নেই। যদিও অনেকে মনে করেন, “অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান এবং সুযোগ সুবিধা দেশের অন্য যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে উন্নত।” বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বহু শিক্ষক স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি করতে গেছেন, অনেক বিষয়ের ওপর গবেষণা কাজও পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। কিন্তু তারপরও দুর্ণাম ঘুচছে না প্রতিষ্ঠানটির।

৮৬ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখতে এসে নিহত হয়েছেন প্রায় ৮০ জন তরুণ। আর এর প্রায় সবই ঘটেছে স্বাধীনতার পর। বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হয়নি।

১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হলেও অনেকে মনে করেন, সরকারের ইঙ্গিত ছাড়া এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় না।

বিভিন্ন সময় দলীয় লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুষ্টক্ষত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষক রাজনীতি এবং অধ্যাদেশেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অনেকে। অধ্যাদেশ সংশোধন বা পরিমার্জন করা এখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বাস্তবতার নিরিখে। তবে সে পরিবর্তন অবশ্যই হওয়া প্রয়োজন শিক্ষার স্বার্থে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রকে সুনিশ্চিত করতে উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বডিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। সিনেট, সিন্ডিকেট, ডিন, একাডেমিক কাউন্সিল, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, শিক্ষক সমিতি, ভিসি প্যানেল ইত্যাদি নির্বাচনে বছরের অধিকাংশ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিগত ৩৫ বছরে এ উদারতা এবং গণতান্ত্রিকতা রূপান্তরিত হয়েছে প্রকাশ্যে দলবাজিতে, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লেখাপড়া, শিক্ষক নিয়োগ এবং গবেষণা কার্যক্রমে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান আগের মতো নেই একথা অনেকেই বলে থাকেন। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩০,৯৭০ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন মাত্র ১,৭০০ জন। ছাত্র শিক্ষক অনুপাত ১ঃ১৮। ১,৭০০ জন শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ৩০০ জন আছেন শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিদেশে, এছাড়া অনেকে ব্যস্ত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় কনসালটেন্সি এবং অনেকে ব্যস্ত দলীয় রাজনীতি নিয়ে। অনেক শিক্ষক আবার বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতেও জড়িয়ে পড়ছেন। পরিবর্তনশীল জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন প্রশিক্ষিত শিক্ষক। অথচ শিক্ষকেরা সে রকম কোন প্রশিক্ষণ পায় না। ২০০৭-০৮ সালের বাজেটে শিক্ষক প্রশিক্ষণ খাতে অর্থ বরাদ্ধ দেয়া হয়েছিল মাত্র ১৩ লাখ টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী একজন প্রভাষক সপ্তাহে ১৬টি ক্লাস, সহকারী অধ্যাপক ১৪টি ক্লাস, সহযোগী অধ্যাপক ১২টি ক্লাস এবং অধ্যাপক ৮ থেকে ১০টি ক্লাস নেয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ বিভাগেই এ নিয়ম মানা হয় না। শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক কনসালটেন্সি বা অন্য কোন আর্থিক সুবিধাসম্পন্ন কাজ করলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে কোন সংস্থার পক্ষে কনসালটেন্সি বন্ধে ১৩টি কমিটি রয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রতিবছরই প্রচুরসংখ্যক শিক্ষার্থী ড্রপ আউট হয়ে যায়। এ ড্রপ আউটের কারণ কী বা ড্রপ আউট হওয়া শিক্ষার্থীরা কোথায় যাচ্ছে এসবের কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। অথচ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাই সাধারণত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তাছাড়া বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা বছরের পর বছর পরীক্ষায় পাশ করে যাচ্ছে ট্রাডিশনাল নোটের সহায়তা নিয়ে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি বড় সমস্যা হলো সেশন-জট। সেশন-জটের কবলে পড়ে শিক্ষার্থীদের জীবনের গুরূত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

ভুয়া ভর্তি বা জালিয়াতি করে ভর্তি এবং ভুয়া সার্টিফিকেট কেনাবেচার অভিযোগও বহু পুরানো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে কোন কারচুপি বা জালিয়াতি ছিল না-এ বিষয়টি নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গর্ববোধ করতেন। তাই এসব জালিয়াতির ঘটনা অনেককেই ভাবিয়ে তুলছে। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে সার্টিফিকেট জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

প্রভাষক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত পদের শিক্ষকদের প্রমোশন ও ইনক্রিমেন্ট ইত্যাদির জন্য গবেষণা প্রবন্ধ বাধ্যতামূলক হলেও এ বিষয়েও আছে ব্যাপক শূন্যতা। অন্যান্য অনুষদে যাই আছে কলা এবং সমাজবিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষকদের গবেষণা এবং প্রকাশনার সংখ্যা মোটেই সন্তোষজনক নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়-বরাদ্দের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশনের মাধ্যমে সরকারি তহবিল থেকে। এ বাজেটের আবার শতকরা ৯০ ভাগের বেশির ভাগ ব্যয় হয় বেতনভাতা ও অবকাঠামোগত খাতে। বাকি অর্থ ভাগ ব্যয় হয় শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা খাতে। প্রতিবছরই এ বরাদ্দের হার কমছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৪টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও গত ৮৮ বছরে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম সম্পাদিত হয়নি। অর্থের অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব গবেষণা কেন্দ্র মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অথচ গবেষণা এবং নতুন নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ।

বিভিন্ন সরকারের সবুজ সঙ্কেতের অভাবে ১৯৯০ সালের পর থেকে ডাকসু নির্বাচন হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং অন্যান্য পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। অছাত্র, বহিরাগত ক্যাডার বা ক্ষমতাসীনদের আর্শীবাদপুষ্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম। সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন নেতৃত্ব। নির্বাচিত নয় বলে কোন দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতাও নেই।

গত কয়েক দশক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে। এখানে জিপিএ ফাইফ (গোল্ডেন অ+) পাওয়া ছাত্রকেও থাকতে হয় ঘিঞ্জি পরিবেশ তথা গণরুমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি আবাসিক হলে ৯ হাজার আসনের বিপরীতে এর দ্বিগুণেরও বেশি শিক্ষার্থী বসবাস করে। এতে লেখাপড়ার কী অবস্থা হয় তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। ক্যান্টিন ও ডাইনিংগুলো থেকে যে খাদ্য সরবরাহ করা হয় তাতে হল প্রশাসনের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ডাইনিং-ক্যান্টিন দেখার জন্য এক বা একাধিক আবাসিক শিক্ষক থাকলেও তাঁরা খুব একটা নজর দেন না। এই নজরদারির অভাব, রাজনীতি, দলীয়করণ, অর্থলিপ্সার কারণে ক্রমেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিম্নমুখী হতে চলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দায়িত্ব ছিল জ্ঞানের বিস্তার ও নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী এসব দায়িত্ব পালন করছে যথাযথভাবে? দেশের ক্রান্তিকালে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পালন করেছে প্রধান ভূমিকা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও দেশ গঠন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন বা অধিকার আদায়ে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তারা বিশ্বাস করে স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব জরাব্যাধি ও প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ফিরে পাবে তার হারানো ঐতিহ্য ও গতিময়তা।

সামহোয়ারইনব্লগ ডটকম, ০৫ জানুয়ারি, ২০০৭

Leave a Reply

Your email address will not be published.