সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার জনাব মো. রফিকুল ইসলাম-এর একটি মন্তব্য অনেকেরই দৃষ্টি আর্কষণ করছে। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় এক মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো দল যদি নির্বাচনে না আসে সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়। সংবিধান মোতাবেকই আগামী সংসদ নির্বাচন হবে’ (প্রথম আলো, ২৪ মার্চ ২০১৮)। তার এই বক্তব্য অনেককেই হতাশ করেছে। কারণ সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন যদি উদ্যোগী না হয় তাহলে বিগত রকিব উদ্দিন কমিশনের মত এই কমিশনও ব্যর্থতার পরিচয় দিবে।
আমরা মনে করি, সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বজায় থাকে না, সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত হয় না, দেশে দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সর্বোপরি সেই নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। এক্ষেত্রে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি (ষষ্ঠ) ও ২০১৪ সালের ০৫ জানুয়ারির (দশম) একতরফা নির্বাচন। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করায় সেই নির্বাচনে ৪৯ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। মোট ভোট গৃহীত হয়েছিল মাত্র ২১ শতাংশ। নির্বাচনের পর ষষ্ঠ সংসদ মাত্র ১১ দিন স্থায়ী ছিল। ঐ সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল (সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) গৃহীত হয়। আর বিগত দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-সহ ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় ১৫৩ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হন, ৯ কোটি ১৯ লাখ ভোটারের মধ্যে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান অবশিষ্ট ৪ কোটি ৩৯ লাখ এবং প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ৪০ শতাংশ। এর বীপরিতে অর্থাৎ সব দলের অংশগ্রহণে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সে নির্বাচনে সবাই ভোট দিতে পারেন, নির্বাচনটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং সেই নির্বাচন গণতন্ত্রকে সংহত করে।
এর আগে ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর তারিখে সংলাপ-পরবর্তী নির্বাচন কমিশন আয়োজিত একটি সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেছিলেন, সরকার যেভাবে আইন করে দেয়, নির্বাচন কমিশনকে সেভাবেই নির্বাচন করতে হয় (প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর ২০১৭)। সিইসির ওই বক্তব্যটি ছিল হতাশাজনক ও উদ্বেগজনক। কারণ আমরা মনে করি, সরকার যেভাবে নির্বাচন করতে চায় সেভাবে নির্বাচন করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয়, বরং একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করা কমিশনের দায়িত্ব।
আমাদের সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছদে অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আর এ নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তথা মানসম্মত। সাম্প্রতিক সময়ে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়াকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে কমিশনের দায়িত্ব রয়েছে, যা কমিশন এড়াতে পারে না।
আমরা জানি গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। আর সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত ও কার্যকর করবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। আর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু মানদণ্ড অনুসরণ করতে পারে। মানদণ্ডগুলো হলো: (১) ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়ায় যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য ছিলেন তারা ভোটার হতে পেরেছেন; (২) যারা প্রার্থী হতে চেয়েছেন তারা প্রার্থী হতে পেরেছেন; (৩) ভোটারদের সামনে বিকল্প প্রার্থী ছিল; (৪) যারা ভোট দিতে চেয়েছেন তাঁরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছেন; এবং (৫) ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া ছিল স্বচ্ছ, কারসাজিমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য।
আমরা মনে করি, একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে (অনুচ্ছেদ ১১৮) নির্বাচন কমিশন সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে পদক্ষপে নিবে। আর কমিশন যদি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশে আবারও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের দিকে ধাবিত হবে, ব্যাহত হবে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন, যা আমাদের কারো কাম্য হতে পারে না। আমরা আশা করি, কমিশন দায়িত্বশীল বক্তব্য দেবে, জনগণের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হবে, সর্বোপরি একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপক্ষে, প্রতিযোগিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে সংশ্লিষ্ট সবাই যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন।
প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০১৮