চীনা ব্যবসা-বাণিজ্যের ‘গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর’ জ্যাক মা’র জীবনকাহিনি

Jack Ma, Executive Chairman, Alibaba Group Holding, People’s Republic of China; Member of the Board of Trustees, World Economic Forum, speaking during the session, Enabling eCommerce: Small Enterprises, Global Players, at the Annual Meeting 2018 of the World Economic Forum in Davos, January 24, 2018. Copyright by World Economic Forum / Ciaran McCrickard

জ্যাক মা একজন চীনা ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও মানবহিতৈষী। তিনি বিশ্বের অন্যতম বড় অনলাইন শপ আলিবাবা’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও নির্বাহী চেয়ারম্যান।

মুক্তবাজার অর্থনীতির অন্যতম প্রবক্তা এবং স্টার্টআপ বিজনেসের একজন রোল মডেল জ্যাক মা। তাঁকে চীনা ব্যবসা-বাণিজ্যের অলিখিত ‘গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আলিবাবা’ এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা পাইকারি ও ই-কমার্স কোম্পানি, যা ‘পূবের আমাজন’ নামে পরিচিত।

ফোর্বস সাময়িকীর মতে, ৫৬ বছর বয়সী জ্যাক মা বর্তমানে (২০২১) চীনের চতুর্থ শীর্ষ ধনী, এশিয়ার ষষ্ঠ শীর্ষ ধনী এবং বিশ্বের ২৬তম শীর্ষ ধনী। ২০২১ সালের জুনে তাঁর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬.১ বিলিয়ন ইউএস ডলার।

২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন জ্যাক মা’কে বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ৫০ নেতার মাঝে দ্বিতীয় স্থান দেয়। চীন, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে অবহেলিত মানুষের কল্যাণে ভূমিকা রাখার জন্য ২০১৯ সালে ফোর্বস সাময়িকী জ্যাক মা’কে ‘Asia’s 2019 Heroes of Philanthropy’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।

পৃথিবীজুড়ে মানুষ তাঁকে চেনে তাঁর অটল সংকল্পের কারণে। নিম্নবিত্ত এক পরিবারে জন্ম নেওয়া জ্যাক মা লেখাপড়ায় ভালো ছাত্র ছিলেন না। চাকরিতে আবেদন করে বারবার তাঁকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছিল। আলিবাবা প্রতিষ্ঠার আগে তিনি আরও দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেছিলেন। কিন্তু এদের কোনোটিই তখন সফলতার মুখ দেখেনি। বলা যায়, আলিবাবা প্রতিষ্ঠা করার আগে সত্যি সত্যিই একজন পুরোপুরি ব্যর্থ মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর জীবনের একটি শক্তিশালী দিক হলো তাঁর প্রবল ইচ্ছাশক্তি। কঠোর পরিশ্রম ও প্রবল ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে তিনি নতুন উদ্যমে, নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছেন। শত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে পৌঁছেছেন সাফল্যের শিখরে।

জ্যাক মা’র জীবন তাই একটি ইতিহাস এবং উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। চরম দুরাবস্থা আর ব্যর্থতার মাঝে স্বপ্ন আর আশার আলো জ্বেলে রেখে জীবনযুদ্ধে সফল হওয়ার এক অনন্য উদাহরণ তিনি।

জন্ম ও শৈশব

জ্যাক মা’র আসল নাম মা ইউন। তাঁর জন্ম হয় ১৯৬৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, চীনের ঝি-জিয়াং প্রদেশের হ্যাংঝোউ শহরে, এক দরিদ্র পরিবারে। তাঁর বাবা মা-লাইফা ছিলেন পেশাদার গল্প বলিয়ে ও সংগীত শিল্পী। মায়ের নাম চুই ওয়েনচাই। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় গান গেয়ে বেড়াতেন। এই পেশায় আয়-রোজগার খুব বেশি হতো না। দুই ভাই ও এক বোনের মাঝে দ্বিতীয় জ্যাক মা।

জ্যাক মা’র দাদা ছিলেন চীনের জাতীয়তাবাদী দলের একজন স্থানীয় নেতা। কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুং জাতীয়তাবাদী দলকে হারিয়ে দেওয়ার পর জ্যাক মা’র দাদাকে কমিউনিস্ট পার্টির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

শিক্ষাজীবন

লেখাপড়ায় তেমন একটা ভালো না হলেও জ্যাক মা শৈশবকাল থেকেই ইংরেজি শেখা শুরু করেন। চীনে তখন ইংরেজি শেখার সুযোগ ছিল না, ইংরেজিতে কোনো বইও পাওয়া যেত না। জ্যাক মা হ্যাংঝোউ ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে আসা ইংরেজ ভাষী পর্যটকদের ফ্রি গাইড হিসেবে কাজ করতেন। প্রায় নয় বছর তিনি এই কাজ করেন। এ সময় পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে ইংরেজি শেখার জন্য তাঁকে প্রতিদিন ২৭ কিলোমিটার রাস্তা বাই-সাইকেল চালাতে হতো! একসময় এক পর্যটকের সঙ্গে তাঁর কলম-বন্ধুত্ব হয়ে যায়, যার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত চিঠি চালাচালি হতো। সেই পর্যটকই মা ইউন নাম পরিবর্তন করে ‘জ্যাক মা’ নাম দেন। কারণ চীনা নামটি ইংরেজদের জন্য উচ্চারণ করা কঠিন ছিল।

বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে থাকার ফলে জ্যাক মা’র দুটো অমূল্য শিক্ষা লাভ হয়েছিল – প্রথমত, বিদেশিদের সঙ্গে থেকে তিনি পশ্চিমা ঢঙে চোস্ত ইংরেজি বলা রপ্ত করেছিলেন, দ্বিতীয়ত, তাদের নানা অভিজ্ঞতা ও তাদের সাথে ঘোরাফেরা জ্যাক মা’র মনকে অনেক বড় করে দিয়েছিল। সীমিত গ-ির বাইরে গিয়ে সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলেন জ্যাক মা।

বিদ্যালয় আর গুরুজনদের গতানুগতিক শিক্ষার সঙ্গে পর্যটকদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষার যে বিস্তর ফারাক তা জ্যাক মা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি কৈশোরেই নিজের জন্য ভিন্ন এক অভ্যাস গড়ে তোলেন – যেটাই পড়তেন, দেখতেন, শুনতেন সেটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন।

জ্যাক মা অল্প বয়সেই ইংরেজি শিখে নিলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষার সময় তিনি দু’বার অকৃতকার্য হয়েছিলেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও তিনবার অকৃতকার্য হন। তাঁর শহর হাংঝোউতে মাত্র একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল। ছাত্রদের লেখাপড়ার মান অনেক খারাপ ছিল দেখে সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়া কাউকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে চাইত না কেউ। উল্লেখ্য, স্কুলে পড়াকালীন জ্যাক মা স্টুডেন্ট কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন।

চীনে সে সময় বছরে কলেজ ভর্তি পরীক্ষা হতো মাত্র একবার। সব কলেজেই একই সময়ে পরীক্ষা হতো। কিন্তু পরীক্ষায় পাশ করে কলেজে সুযোগ পেতে জ্যাক মা’র চার বছর লেগেছিল। তিনি ১৯৮৮ সালে হ্যাংঝোউ টিচার্স ইন্সটিটিউটের (বর্তমানে এর নাম হ্যাংঝোউ নরমাল ইউনিভার্সিটি) ইংরেজি বিভাগ থেকে বিএ পাশ করেন। এরপর ২০০৬ সালে বেইজিং-এর ‘চিউং-কং গ্রাজুয়েট স্কুল অব বিজনেস’ থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় ডিগ্রি নেন। জ্যাক মা হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য দশবার আবেদন করেন, কিন্তু প্রত্যেকবারই তাঁর আবেদন বাতিল করা হয়।

জ্যাক মা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘এতবার প্রত্যাখ্যাত আর, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে কিন্তু বেশ উপকারই হয়েছিল আমার! কারণ আমাদের মতো কিছু মানুষ, যাদের অন্য অনেক কিছু করার যোগ্যতা নেই, তারা উদ্যোক্তা হয়।’

জ্যাক মা জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যতবার অকৃতকার্য হয়েছেন:

১. প্রাথমিক পরীক্ষায়: ২ বার

২. মাধ্যমিক পরীক্ষায়: ৩ বার

৩. পুলিশ হতে গিয়ে: ১ বার

৪. হার্ভার্ডে ভর্তির চেষ্টায়: ১০ বার

৫. কেএফসির চাকরিতে: ১ বার।

কর্মজীবন

গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর জ্যাক মা ‘হ্যাংঝোউ দিয়ানজি ইউনিভার্সিটি’তে প্রায় ছয় বছরের মতো ইংরেজি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য (ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড) এই বিভাগ দুটিতে শিক্ষকতা করেন। এর আগে তিনি ৩০টি চাকরির জন্য চেষ্টা করে সবকটাতেই ব্যর্থ হন।

আমেরিকান টিভি-হোস্ট চার্লি রোজের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জ্যাক মা বলেছিলেন: ‘আমি যখন পুলিশের চাকরির জন্য আবেদন করলাম, দশজনের মধ্যে নয়জনের চাকরি হলো; আমাকে বলা হলো, ‘তুমি উপযুক্ত নও’। আমার শহরে যখন কেএফসি আসলো, আমরা ২৪ জন চাকরির আবেদন করেছিলাম। ২৩ জনের চাকরি হলো, আমি বাদ পড়লাম। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে আমি দশবার আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম। তারপর চিন্তা করলাম, ‘হয়তো একদিন আমি হার্ভার্ডে লেকচার দেব।’

আরেকটি সাক্ষাৎকারে জ্যাক বলেছিলেন, ‘২০০৩ সালে যখন আমরা ‘তাওবাও’ শুরু করি, তখন আমার টিমের সবাইকে বলা হয়েছিল, বাসায় গিয়ে বিক্রয় করার মতো চারটি জিনিস নিয়ে আসতে। আমাদের বেশিরভাগই বিক্রয় করার মত চারটি জিনিস বাসায় খুঁজে পাইনি। কারণ আমরা আর্থিকভাবে খুবই দরিদ্র ছিলাম।’

তরুণ বয়সে জ্যাক মা

আলিবাবা শুরু করার আগে জ্যাক মা আরও দু’টো ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু এর একটিতেও বলার মতো সাফল্য পাননি তিনি। উল্লেখ্য, সে সময় চীন দেং জিয়াওপিং-এর অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রথম দশক পার করছিল।

জ্যাক মা তাঁর ইংরেজি শিক্ষকের চাকরিটা বেশ উপভোগ করতেন। কিন্তু বেতন ছিল খুবই কম। মাসে মাত্র ১২ ডলার! এই সামান্য বেতনে বলতে গেলে কিছুই করা যায় না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসা। এত কষ্ট করে লেখাপড়া করার পেছনেও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু লেখাপড়ার পর সম্মানজনক একটা চাকরি পেয়েও তাঁর আর্থিক অবস্থা খারাপই রয়ে গেল।

এক সময় তাঁর মনে হলো, তিনি ইংরেজির জ্ঞান কাজে লাগিয়ে একটি ব্যবসা শুরু করতে পারেন। ৯০ দশকের একদম শুরুর দিকে তিনি তাঁর অনুবাদ সংস্থা বা ট্রান্সলেশন ফার্ম খুলে বসলেন। তাঁর ফার্মের নাম ছিল ‘হাংঝোউ হাইবো ট্রান্সলেশন এজেন্সি’। অর্থের বিনিময়ে চীনা ভাষা থেকে ইংরেজি এবং ইংরেজি থেকে চীনা ভাষায় বিভিন্ন জিনিস অনুবাদ করতেন। মাঝে মাঝে দোভাষীর কাজও করতেন। কিন্তু এসব করে তাঁর আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না! সংসারের খরচ চালাতে তখনো তাঁকে রাস্তায় মাল টানাটানির কাজে শ্রম দিতে হতো। কিন্তু অনুবাদক হিসেবে কাজ করার সুবাদে তিনি অসাধারণ একটি সুযোগ পেলেন, যেটি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় চিরদিনের জন্য!

যুক্তরাষ্ট্রে গমন এবং ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচয়

১৯৯৫ সালে স্থানীয় পৌরসভার পক্ষ থেকে একজন দোভাষী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করার সুযোগ পান জ্যাক মা। এর এক বছর আগে ১৯৯৪ সালে তিনি প্রথমবার ইন্টারনেট সম্পর্কে জেনেছিলেন, কিন্তু স্বচক্ষে দেখা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর ৩০ বছর বয়সে তিনি প্রথম স্বচক্ষে ইন্টারনেট দেখেন এবং বিষয়টি তাঁকে দারুণ প্রভাবিত করে।

ইন্টারনেটের গতি ছিল তখন ভীষণ ধীর। জ্যাক মা’র এক বন্ধু তাঁকে কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ দেন। তিনি ভয়ে কম্পিউটার স্পর্শই করেননি সেদিন! কারণ চীনে তখন কম্পিউটারের দাম ছিল আকাশছোঁয়া, নষ্ট হয়ে গেলে তখন দাম দিতে পারতেন না তিনি। কিন্তু বন্ধুর উৎসাহে ভরসা পেলেন, কাঁপা কাঁপা হাতে ইন্টারনেটে প্রথম সার্চ করেন। ইতিহাস বদলে দেওয়া একটি মুহূর্তের সূচনা ঘটে এভাবেই।

জ্যাক মা ইন্টারনেটে প্রথম যে শব্দটি লিখে সার্চ দেন, তা ছিল ‘বিয়ার’। বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানির বিয়ার সার্চ এলেও চীনের কোনো কোম্পানি সেখানে ছিল না। যদিও চীনে বেশ ভালো বিয়ার তৈরি হত। এছাড়া তিনি চীন সম্পর্কিত আরও কিছু বিষয় সার্চ করেন, কিন্তু তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। বিষয়টি জ্যাক মাকে বেশ ভাবনায় ফেলে। আর তখন থেকেই তাঁর মাথায় ইন্টারনেট ব্যবহার করে ব্যবসা করার চিন্তা আসে।

ব্যবসায়িক অধ্যায়

ইন্টারনেটে চীন ও চীনা পণ্য সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য না পেয়ে জ্যাক মা সেই সময়েই তাঁর আমেরিকান বন্ধুদের সহায়তায় চীন সম্পর্কিত একটি ওয়েবসাইট খোলেন। ওয়েবসাইটি চালু হয় সকাল ৯:৪০টায় এবং দুপুর ১২:৩০টার মধ্যেই চীনের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য ই-মেইল করেন! জ্যাক মা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলেন যে, ইন্টারনেট দিয়ে ব্যবসা শুরু করা যায়।

১৯৯৫ সালের এপ্রিলে জ্যাক মা, স্ত্রী ক্যাথি ঝাং, কম্পিউটার শিক্ষক হি উইবিং ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে ২০ হাজার মার্কিন ডলার যোগাড় করে তাদের প্রথম কোম্পানি শুরু করেন। ‘চায়না পেজেস’ (www.yellowpages-china.com) নামের এই কোম্পানি অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন চীনা প্রতিষ্ঠানকে ওয়েবসাইট তৈরি করে দিত। ১৯৯৫ সালের ১০ মে তারিখে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের চায়না পেজেস ডটকমের ডোমেইন নিবন্ধন করেন।

আলিবাবার কার্যালয়

কোম্পানিটি চালাতে জ্যাক মা তাঁর আমেরিকান বন্ধুদের সাহায্য নিতেন। চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও চুক্তি ইত্যাদি তিনি নিজে দেখতেন। ২০১০ সালে এক সম্মেলনে জ্যাক মা জানান, তিনি জীবনে কোনোদিন এক লাইন কোড (প্রোগ্রামিং) লেখেননি। ৩৩ বছর বয়সে প্রথম তিনি নিজের জন্য একটি কম্পিউটার কিনেছিলেন।

অন্য আরেকটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রথম যেদিন আমরা ওয়েবে যুক্ত হই, সেদিন আমি আমার বন্ধু-বান্ধব ও কিছু টিভি সাংবাদিককে আমন্ত্রণ করেছিলাম। খুবই ধীরগতির একটি ডায়াল-আপ কানেকশন সেট করে আমি ইন্টারনেট চালু করেছিলাম। পেজটির অর্ধেক লোড হতেই সাড়ে তিন ঘণ্টা লেগেছিল। এই সময়টায় আমরা খাওয়া-দাওয়া ও আড্ডাবাজি করে কাটিয়েছিলাম। কিন্তু আমার খুব গর্ব হচ্ছিল। আমি ওদের কাছে প্রমাণ করেছিলাম যে, ইন্টারনেট বলতে সত্যিই কিছু আছে!’

চায়না পেজেস কোম্পানিটি তিন বছর চালানোর পর তাঁদের হাতে ৫০ লাখ রেনমিনবি বা আট লাখ মার্কিন ডলারের মত মূলধন দাঁড়ায়।

১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত জ্যাক মা চীনের বৈদেশিক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের (Ministry of Foreign Trade and Economic Cooperation) অধীন একটি প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানি চায়না ইন্টারন্যাশনাল ইলেক্ট্রনিক কমার্স সেন্টারের (China International Electronic Commerce Center) প্রধান হিসেবে কাজ করেন।

আলিবাবা অধ্যায়

১৯৯৯ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে জ্যাক মা নিজের শহর হ্যাংঝোউ-এ ফিরে আসেন এবং ইন্টারনেটভিত্তিক একটা ব্যবসা গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন জোগাড় হবে কীভাবে? তিনি ব্যবসায় অংশীদারিত্বের জন্য তাঁর ২৪ জন বন্ধুকে বাসায় নিমন্ত্রণ করলেন।

পাক্কা দুই ঘণ্টা তাঁর চিন্তা (আইডিয়া) সবাইকে বোঝানোর পর তিনি আবিষ্কার করলেন তাঁর চিন্তার বিন্দু-বিসর্গ কিছুই বোঝেনি কেউ! ২৪ জনের মধ্যে মাত্র একজন জ্যাক মা’র পাশে থাকতে রাজি হলেন। তবে তাঁর সেই বন্ধু শর্ত দিলেন, যদি দেখা যায় তারা তেমন কোনো লাভের মুখোমুখি হচ্ছেন না, তাহলে তারা এই ব্যবসা থেকে ফেরত যাবেন, আর সামনের দিকে অগ্রসর হবেন না।

আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে এমন অনেক মানুষের সঙ্গে আমাদের দেখা মেলে, যাদের কাছ থেকে যে কোনো কাজে ‘না’ ছাড়া অন্য কিছু আশা করা যায় না। এমনকি মহৎ কোনো সামাজিক কাজেও তারা প্রথমেই ‘না’ বলে বসেন। এই ‘না’য়ের পেছনে তাদের অজুহাতেরও সীমা থাকে না। কিন্তু তাই বলে কি বসে থাকলে চলবে? অবশ্যই না। বরং এই ‘না’ বলা মানুষগুলোকে বাদ দিয়েই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়।

তেমনটাই করেছিলেন জ্যাক মা। তিনি দমে না গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে মানুষজন জোগাড় করেন। ১৮ জন সহ-প্রতিষ্ঠাতাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাসায় পাঁচ লাখ ইউয়ান মূলধনের নতুন একটি চীনভিত্তিক স্টার্টআপ শুরু করেন। বিজনেস-টু-বিজনেস ওয়েব মার্কেটপ্লেস হিসেবে তখনকার সময়ে পরিচিত ই-কমার্স সাইটটিই হলো আজকের বিখ্যাত ‘আলিবাবা’।

আলিবাবা নামকরণের ইতিহাস বলতে গিয়ে জ্যাক মা বলেছিলেন: ‘শুরু করার সময়ে আমার মনে হয়েছিল, ইন্টারনেট যেহেতু একটি বৈশ্বিক ব্যাপার, আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামটিও বৈশ্বিক হওয়া উচিত। সেইসঙ্গে নামটি যেন সহজেই চেনা যায়। সেই সময়ে ইয়াহু (ণধযড়ড়) নামটি ছিল সেরা। আমি অনেক দিন ধরে এমন একটি নাম বের করার চেষ্টা করছিলাম।  তারপর হঠাৎ মনে হলো ‘আলিবাবা’ নামটি ভালো হতে পারে।

সৌভাগ্যই বলতে হবে, চিন্তাটি মাথায় আসার সময়ে আমি সানফ্রান্সিস্কোর একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। পরিচারিকা (ওয়েট্রেস) খাবার পরিবেশন করতে এলে আমি তাঁকে বললাম আলিবাবাকে সে চেনে কি না। সে বলল সে চেনে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আলিবাবা কী? সে বলল- ‘চিচিং ফাক!’ অসাধারণ!

রাস্তায় বের হওয়ার পর আমি প্রায় ২০ জন মানুষকে আলিবাবা সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। সবাই আলিবাবা, ৪০ চোর ও তাদের গুপ্তধন- সবই জানে। আমি বুঝে গেলাম এটা আসলেই দারুণ একটা নাম হতে পারে। বলতে গেলে সবাই এটা একবারে ধরতে ও মনে রাখতে পারবে, আর নামটা শুরু হয় ‘আ’ (অ) দিয়ে।’

আলিবাবা’র যাত্রার দিন তিনি তাঁর সহ-প্রতিষ্ঠাতাদের খুব পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, ‘আমরা যদি সফল হই, তার মানে হলো চীনের শতকরা আশি ভাগ তরুণের পক্ষেই সফল হওয়া সম্ভব!’

কারণ তাঁরা সফল হবেন এটা কল্পনা করাও ছিল কষ্টসাধ্য। কেউ তাদের পেছনে বিনিয়োগ করেনি। না ছিল ক্ষমতা, না ছিল উপরমহলে যোগাযোগ, না কোনো সামাজিক অবস্থান। সম্বল বলতে তেমন কিছুই ছিল না। তাঁরা ১৮ জন ৫ লাখ রেনমিনবি (আরএমবি) করে বিনিয়োগ করেছিলেন।

সিদ্ধান্ত হয়েছিল অন্তত বারো মাস এই টাকায় ব্যবসাটা চালিয়ে নেবেন। এর মধ্যে যদি কিছু আয় হয়, তবে ব্যবসা চলবে। নতুবা অন্য কিছু ভাবতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এখানেও পিছু ছাড়লো না, আট মাসের মাথায়ই তাঁদের সব অর্থ ফুরিয়ে গেল! জ্যাক মা পড়লেন অথৈ সাগরে, তাঁদের নিয়ে কারও কোনো আশা আর ছিল না।

আলিবাবায় ১৮ জন মানুষ শুধু এটাই ঠিক করেছিলেন, তাঁরা আপন বিশ্বাসে অটল থাকবেন, চড়াই-উতরাইগুলো একসঙ্গে পাড়ি দেবেন। বারবার ব্যর্থতার মুখে তাঁদের কোনো স্বপ্ন বা কল্পনা ছিল না, ছিল শুধু এক বুক আশা।

আলিবাবাতে তাঁরা একটি বি-টু-বি প্ল্যাটফর্ম চালু করেন, যেখানে চীনের রপ্তানিকারকরা তাঁদের পণ্যের তালিকা দিতে পারবেন। সেই তালিকা দেখে যেন বিদেশি ক্রেতারা এসব পণ্য ক্রয় করতে পারে। এদিকে চীনের অর্থনীতিতে তখন পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। ইন্টারনেট চীনে তখন একটু একটু করে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেছে। সে সময়ে চীনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাগুলোর জন্যে ঋণ যোগাড় করা ছিল কঠিন কাজ। তাদেরকে বড় বড় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হতো। আলিবাবার আগমন এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর দুঃসহ অবস্থা রাতারাতি বদলে দেয়।

অল্প সময়ের মধ্যে আলিবাবা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে আলিবাবা বিখ্যাত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ‘গোল্ডম্যান স্যাক্স’ থেকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার এবং ২০০০ সালের জানুয়ারিতে ‘সফটব্যাংক’ থেকে বিশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দুইবারে মোট ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার- বিনিয়োগ পায়। জ্যাক মা বুঝতে পারেন সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

আস্তে আস্তে জ্যাক মা তাঁর কোম্পানিকে গ্লোবাল ই-কমার্স সিস্টেমের আওতায় উন্নীত করার চেষ্টা করেন। সে প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০০৩ সালে ই-বে (বইধু)-এর আদলে তাওবাও, আলি-পে, আলি মামা ও খুহী প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এর মধ্যে তাওবাও মার্কেটপ্লেস বেশ দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে এবং এটি দারুণ সফল একটি ই-কমার্স সাইটে পরিণত হয়। এই সাফল্যের কারণে সে সময় বর্তমান বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তর ই-কমার্স কোম্পানি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করা ই-বে থেকে তাওবাও’কে কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

কিন্তু জ্যাক মা তাঁদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর বদলে ২০০৫ সালে ইয়াহুর সহ-প্রতিষ্ঠাতা জেরি ইয়াং আলিবাবা থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ৪০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেন। এটা ছিল আলিবাবার জন্যে বিশাল অর্জন। চীনের অনলাইনভিত্তিক কেনাবেচার বাজারে আলিবাবার সঙ্গে তখন ই-বে’র হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এ বিনিয়োগের ফলে আলিবাবা ও ইয়াহু দু’পক্ষই দারুণভাবে লাভবান হয়।

জ্যাক মা ইয়াহুর এক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ নিয়ে তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে থাকেন। তাঁর সঠিক সিদ্ধান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ এবং হাল ছেড়ে না দেওয়ার ফলাফল হিসেবে আলিবাবা বর্তমানে বিজনেস-টু-বিজনেস, বিজনেস-টু-কাস্টমার এবং কাস্টমার-টু-কাস্টমার সার্ভিস দেওয়া কয়েকশ’ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। অথচ জ্যাক মা’র সেসব উদ্যোগ সেই সময়ে পাগলামি হিসেবে দেখা হয়েছিল। কেউ ভাবেনি যে, প্রতিটি উদ্যোগেই জ্যাক মা সফল হবেন। সেই সময়ে একটি পত্রিকা তাঁকে ‘ক্রেজি জ্যাক’ বা ‘পাগল জ্যাক’ নামে অভিহিত করেছিল।

বর্তমানে আলিবাবার মালিকানাধীন তাওবাও মার্কেটপ্লেস বিশ্বের অন্যতম ই-কমার্স ওয়েবসাইট এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভিজিট হওয়া ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে অন্যতম। অ্যালেক্সার রিপোর্ট অনুযায়ী (২০২১), চীনে ভিজিট হওয়া সাইটগুলোর মধ্যে এটির অবস্থান পঞ্চম। অ্যালেক্সার ২০১৮ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসে গড়ে ৬১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ তাওবাও সাইটটি ভিজিট করেন।

আলি পে (এর প্যারেন্ট কোম্পানি হলো অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়াল) পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ‘ফিনটেক’ বা আর্থিক প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানি। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী এর ব্যবহারকারী সংখ্যা ৮৭০ মিলিয়ন। চীনে মোবাইল পেমেন্ট সেবার প্রায় ৯০ ভাগ রয়েছে টেনসেন্ট-এর ডবপযধঃ ও আলি পে’র দখলে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে বিকাশ লিমিটেডের ২০ শতাংশ কিনে নেয়।

২০২০ সালের অক্টোবরে আলি পে’র প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘অ্যান্ট গ্রুপ’ ৩৪.৫ বিলিয়ন আইপিও উত্তোলন করে, যার ফলে এর মার্কেট ভ্যালু দাঁড়ায় ৩১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে! মূলত এই আলি-পে’র আইডিয়ার কারণেই জ্যাক মাকে ‘পাগল’ খেতাব দেওয়া হয়েছিল। অথচ বর্তমানে এটি বিশে^র সবচেয়ে বড় মোবাইল আর্থিক সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে বক্তব্য দিচ্ছেন জ্যাক মা

রেকর্ড সৃষ্টিকারী আলিবাবার আইপিও

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আলিবাবা নিউইয়র্ক স্টক এক্সেচেঞ্জে আইপিও (ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং) ছাড়ে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ পায়! এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম বড় আইপিও’র ঘটনা। এই আইপিও’র পর আলিবাবা বিশ্বের অন্যতম দামী প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

আলিবাবা’র চেয়ারম্যান হিসেবে

জ্যাক মা দীর্ঘদিন আলিবাবার নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, আলিবাবা গ্রুপের অধীনে নয়টি বড় কোম্পানি রয়েছে:     ১. আলিবাবা ডটকম; ২. তাওবাও মার্কেটপ্লেস; ৩. তাওবাও মল; ৪. ই-তাও; ৫. আলিবাবা ক্লাউড কম্পিউটিং; ৬. জুহুয়াসুয়ান; ৭. ১৬৮৮ ডটকম; ৮. আলি এক্সপ্রেস; ও ৯. আলি পে (এর প্যারেন্ট কোম্পানি ‘অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়াল’)।

২০১২ সালের নভেম্বরে, আলিবাবার অনলাইন লেনদেনের (ট্রানজেকশন) পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন ইউয়ান অতিক্রম করে। ২০১৬ সালের মধ্যে জ্যাক মা অনেকগুলো কোম্পানির মালিক হয়ে যান।

২০১৭ সালের ৯ জানুয়ারি তারিখে নিউইয়র্কের ট্রাম্প টাওয়ারে জ্যাক মা দেখা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে। বৈঠকের পর জ্যাক মা জানান, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী করতে সম্মত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, আমি ও জ্যাক কিছু দারুণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা ভালো কিছু কাজ করতে যাচ্ছি। ট্রাম্প এ সময় আলিবাবার প্রশংসা করেছেন বলেও জানান জ্যাক মা।

সে সময় আলিবাবার মুখপাত্র বব ক্রিস্টি জানান, আগামী পাঁচ বছরে আলিবাবা যুক্তরাষ্ট্রে দশ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আলিবাবার সঙ্গে কাজ করে তাদের ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করতে পারবেন।

২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে আঠারোতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সংগীতশিল্পী মাইকেল জ্যাকসনের পোশাক ও ভঙ্গিতে জ্যাক মা অভিনয় করেন। একই মাসে তিনি যৌথ উদ্যোগে হংকং-এ ডিজিটাল ওয়ালেট সার্ভিস চালু করার জন্য স্যার লি কা শিং-এর সঙ্গে অংশীদার হন।

২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে আলিবাবার নির্বাহী চেয়ারম্যানের পদ থেকে অবসর গ্রহণের ঘোষণা দেন। এ সময় চীন সরকারের চাপে তাঁকে পদত্যাগ করতে হচ্ছে এমন গুঞ্জন ওঠে। তবে সেই সংবাদের সত্যতা নেই বলে জানান জ্যাক মা। তিনি তাঁর ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মানবহিতৈষী কাজে মনোনিবেশ করতে চান বলে উল্লেখ করেন।

উল্লেখ্য, জ্যাক মা’র প্রতিষ্ঠিত আলিবাবা এখন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে একটি। জানুয়ারি ২০১৮, আলিবাবা দ্বিতীয় এশিয়ান কোম্পানি হিসেবে ৫০০ বিলিয়ন মার্কেট মূল্য অতিক্রম করে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে প্রায় দুশ’ দেশে সেবা প্রদান করছে।

আলিবাবা ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০-এর ২০০০ সূচকে ৩১তম স্থানে, চীনের সংস্থাগুলোর মধ্যে অষ্টম স্থানে রয়েছে (বিক্রয়: ১১৭তম, মুনাফা: ১১তম; সম্পদ: ১৮৭তম; বাজার মূল্য: ৭ম স্থান)। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, আলিবাবা গ্রুপের নিট আয় ১৯.৮২ বিলিয়ন ইউএস ডলার, মোট সম্পদ ১৮৫.৪২ বিলিয়ন ইউএস ডলার, মোট রাজস্ব ৭২ বিলিয়ন ইউএস ডলার (২০২০)। বর্তমানে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন এই গ্রুপে (২০২১)।

আলিবাবা থেকে অবসর গ্রহণ

সবাই যা পারে না, তাই করে দেখিয়েছেন আলিবাবার সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা। ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখে জ্যাক মা আলিবাবা গ্রুপের নির্বাহী চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৫৫ বছর। তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড্যানিয়েল ঝ্যাংয়ের হাতে সব দায়িত্ব দিয়ে সরে যান। এর এক বছর আগে তিনি চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

প্রযুক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট টেক ক্রাঞ্চ এক প্রতিবেদনে বলেছে, চেয়ারম্যান পদ ছাড়লেও ‘আলিবাবা পার্টনারশিপে’র আজীবন সহযোগী হিসেবে থাকবেন জ্যাক মা। ‘আলিবাবা পার্টনারশিপ’ হচ্ছে আলিবাবা গ্রুপের কোম্পানি ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপকদের একটি দল, যাদের হাতে বোর্ড সদস্য নির্বাচনের ক্ষমতা থাকে।

২০১৮ সালে জ্যাক মা অবসরের ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, তিনি স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই আলিবাবা ছাড়ছেন। তাঁর ভাষ্য ছিল, ‘একটা বিষয়ে সবাইকে প্রতিশ্রুতি দিতে পারি তা হলো আলিবাবা কখনো জ্যাক মা সম্পর্কিত কোনো বিষয় ছিল না, কিন্তু জ্যাক মা সব সময় আলিবাবার সঙ্গেই থাকবে।’

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে জ্যাক মা আলিবাবার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন।

আলিবাবার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর দিনটি ছিল চীনে ‘শিক্ষক দিবস’। আর জ্যাক মা মূলত ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তাই এই দিনটিকেই তিনি পদত্যাগের জন্য বেছে নেন। ‘শিক্ষক জ্যাক মা’ হিসেবে খ্যাত আলিবাবার এই উদ্যোক্তা দাতব্য শিক্ষাক্ষেত্রে সময় দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন।

সম্পদের পরিমাণ

ফোর্বসের তথ্যানুযায়ী, জ্যাক মা’র বর্তমান (২০২১) সম্পদের পরিমাণ ৪৮.৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার। যদিও ২০২১ সালের ১২ জুন তারিখে ফোর্বসের রিয়েল টাইম বিলিওনিয়ার্স-এর তালিকায় জ্যাক মা ২৮তম স্থানে রয়েছেন,  তাঁর সম্পদ দেখানো হয়েছে ৪৬.১ বিলিয়ন ইউএস ডলার। অন্যদিকে ব্লুুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, জ্যাক মা বিশ্বের ২৭তম ধনী, সম্পদ দেখানো হয়েছে ৪৮.৯ বিলিয়ন ডলার (১২ জুন, ২০২১)।

আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে পড়তে পারেন সূচীপত্র থেকে প্রকাশিত নেসার আমিন এর “জ্যাক মা: ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব” বইটি। আর্টিকেলটি মূলত এই বইয়েরই নির্বাচিত একটি অংশ। বইটি কিনতে চাইলে ক্লিক করুন রকমারির এই লিঙ্কে 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *