আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বৃহৎ শক্তিবর্গ নিজ নিজ ভাবমূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিটি ঘটনার মূল্যায়ন করে থাকে। তাদের প্রতিক্রিয়া নির্ধরিত হয় ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এমন অনুধাবন থেকেই বৃহৎ শক্তিবর্গ তাদের নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার্থে কেউ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে, আবার কেউ বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ ও ভূমিকা পালন করে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বৈরী সম্পর্ক এবং ভৌগোলিক অবস্থানগত নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে নেয়া ভারতের জন্য অনেকটা অপরিহার্যই ছিল। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে মৈত্রী রক্ষা এবং এ অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে। চীনও পাকিস্তানের সঙ্গে মৈত্রী রক্ষার্থে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়। এ যুদ্ধে পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম প্রকাশ্যে বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অগ্রাসনের নিন্দা জানায়। এ লেখায় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা তুলে ধরা হলো।
ভারতের ভূমিকা:
১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের সামরিক বাহিনী তথা যৌথ বাহিনী পূর্ববাংলায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে স্পষ্টভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হয় এবং চূড়ান্ত বিজয় আসার আগেই ভারত ৬ ডিসেম্বর প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারত বেশ কয়েকটি কারণে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তা করে। প্রথমত, ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর যোগাযোগ করার জন্য শিলিগুড়ি করিডোর ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না। এই সীমিত যোগাযোগের পরিসরটিও ভারতের জন্য নিরাপদ ছিল না এই কারণে যে, এই অঞ্চলটি যে কোনো সময় চীন দ্বারা আক্রান্ত হবার আশঙ্কার মধ্যে ছিল। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় এই অঞ্চলটি চীন কর্তৃক আক্রান্ত হয়। তাই ভারত মনে করেছিল, যদি বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে পৃথক হয় তাহলে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হবে।
দ্বিতীয়ত, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্র, যা ভারতের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের রাজনীতিক মতাদর্শের সঙ্গে ছিল অনেকটাই সঙ্গতিপূর্ণ। এজন্য ভারত মনে করে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আওয়ামীলীগের মত একটি দল ক্ষমতায় আসলে তাদের সঙ্গে কাজ করা সহজ হবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে দুর্বল করা সম্ভব হবে।
তৃতীয়ত, ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়েছিল মূলত দ্বি-জাতি তত্ত্ব বা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে, যা প্রথম থেকেই ভারতীয় কংগ্রেস মেনে নিতে পারেনি। কংগ্রেস চেয়েছিল জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের অসাড়তা প্রমাণিত হোক। ভারত এ ধরনের সুযোগ পায় ১৯৫২ সালে যখন ধর্মের চেয়ে ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিকট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় বাংলাদেশ যাতে একটি ধর্মনিরপক্ষে রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারে এ লক্ষ্যে ভারত মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে সহায়তা করে।
ভারতের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দান বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের ছিল। মার্চ শেষ থেকে এপ্রিল শেষদিক পর্যন্ত এই সময়কালে ভারত বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিকে আশ্রয় দান করে। কোলকাতায় একটি প্রবাসী সরকার গঠনের ব্যবস্থা করে দেয়। এছাড়া পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য স্বল্প পরিমাণে সামরিক সহায়তা দিতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার জন্য ভারত কূটনৈতিক প্রচারণাও অব্যাহত রাখে।
মে প্রথম দিক থেকে জুন শেষ পর্যন্ত এ সময়ে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে, যার কারণে ভারতীয় সরকার পূর্ববাংলার মুক্তি আন্দোলন নিয়ে ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এই সময় ভারত পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলকে সমর্থন দিতে থাকে।
জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ সময়ে ভারত পূর্ববাংলার সমস্যার প্রত্যাশিত সমাধানের জন্য কূটনৈতিক ও সামরিক প্রচেষ্টা জোরদার করে। এ সময় ভারত বিদ্যমান সমস্যা যাতে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং ভারতে বসবাসরত বাংলাদেশি শরণার্থীরা যাতে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে সে ব্যপারে প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দল পূর্ববাংলায় মোতায়েন করা হয়। ভারত কর্তৃক প্রেরিত তিনটি সৈন্যবহরের দুটি ছিল সপ্তম পদাতিক, একটি ছিল নবম পদাতিক, যাদেরকে ভারত পূর্ববাংলার সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করে। এ সময় ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সব ধরনের সমর্থন দানে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিকট থেকে কার্যকর কূটনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন পায়।
৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর- এ সময় ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে, যার মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ সফল হয়। মূলত ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজিত হতে বাধ্য হয় এবং বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মলাভ ত্বরান্বিত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা:
মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নেই পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করে। যে কারণে দেশটি বাংলাদেশের মুক্তিকামী-নিরীহ জনগণের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। তারা অবস্থান গ্রহণ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতার নামে স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার পক্ষে। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম. নিক্সনের একান্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন তার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বিষয়ক একান্ত সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার। আর এই নিক্সনÑকিসিঞ্জার নিয়ন্ত্রিত মার্কিন নীতিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পরিচালিত হয়।
যুদ্ধ চলাকালীন সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও বস্তুগত উভয়ভাবেই সহায়তা করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের কিছুই করার নেই বলে অভিমত প্রকাশ করেন। নিক্সন প্রশাসন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত গণহত্যার খবর সম্বন্ধে যে নির্বিকার ভূমিকা পালন করে, যার মধ্যে বহুল আলোচিত ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ অন্যতম। প্রেসিডেন্ট নিক্সন আশঙ্কা করছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতের আগ্রাসনের ফলে ওই অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান দৃঢ় হবে, যা কিনা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সম্ভাব্য নতুন মিত্র চীনের আঞ্চলিক অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতি সাধন করবে।
উল্লেখ্য, ১৯৫৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেমন আগ্রহ ছিল না। ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সু-সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের ব্যাপারে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে। ধারক নীতির আওতায় কম্যুনিজম সম্প্রসারণ রোধকল্পে যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে সতর্ক হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশ যদি স্বাধীনতা লাভ করে তাহলে এ রাষ্ট্রটি কম্যুনিজম শাসন ব্যবস্থার অধীনে চলে যেতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় এ ব্যবস্থা রোধ করা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মুক্ত বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য দেশটি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করে।
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। ১৯৫৪ সালের ১৯ মে করাচিতে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র একটি সাহায্য ও নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এছাড়া সমাজতন্ত্রের বিস্তার রোধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াকে কেন্দ্র করে ১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালে সিয়াটো ও সেন্টো নামে দুটি প্রতিরক্ষা চুক্তি তথা মৈত্রী জোট গঠন করে। এ মৈত্রী জোট দুটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল পাকিস্তান। তাই যুক্তরাষ্ট্র তার একজন বিশস্ত মিত্রকে রক্ষা করতেই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন দেয়। অন্যদিকে ১৯৫৪ সালে মার্কিন ও পাকিস্তান সামরিক সম্পর্ক শুরু হয়। তা ১৯৬৫ সালে এসে তা সুদৃঢ় আকার পায়। এই ১১ বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাজেটে ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল- এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশস্ত মিত্র পাকিস্তানের সামরিক ব্যবস্থা উন্নত করা। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য তিন বিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়, যাতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ভৌগলিক অখণ্ডতা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আরেকটি বিষয় এখানে কাজ করে; তা হলো- ১৯৬৯ সালে চীনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংঘাত চরমে আসে। যুক্তরাষ্ট্র এটিকে একটি সুযোগ মনে করে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে পাকিস্তানকে মাধ্যম বানাতে প্রচেষ্টা চালায়। ধারণা করা হয় ১৯৭১ সালে কিসিঞ্জারের চীন সফর সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের কারণেই।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস ও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সহায়তা করবে কিনা এ নিয়ে দ্বিমত দেখা দেয়। কারণ এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়লে সোভিয়েত ইউনিয়নও জড়িয়ে পড়বে। ফলে বড় যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হবে। ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধিকার আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সিআইএ এর সমন্বয়ে গঠিত সিনিয়র রিভিউ কমিটির এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সম্ভাব্য ভাষণ, ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান, পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলন ও সামরিক উপায়ে সংঘাত মোকাবিলা এবং ভারতের ভূমিকা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। অর্থাৎ বাঙ্গালির স্বাধিকার আন্দোলন যখন স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নিতে শুরু করল, তখন থেকে ঘটে যাওয়া সবকিছুতে কলকাঠি নেড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ প্রায় সকল ঘটনাই সংঘটিত হয়েছে আমেরিকার জ্ঞাতসারে।
২৫ মার্চ থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পকিস্তানের যুদ্ধে না জড়িয়ে নিরব ভূমিকা পালন করে। জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে পাকিস্তানের সহায়তায় চীন সফর করেন। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মৈত্রী চুক্তির প্রতিপক্ষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়ন হয়। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করে এবং ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ না গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানায়।
সেপ্টেম্বরের শেষ দিক থেকে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ পর্যন্ত ভারতীয় সেনা সদস্যরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক সরকার ও বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দের (যারা ভারত অবস্থান করেছিলেন) মধ্যে গঠনমূলক একটি রাজনৈতিক সংলাপ আয়োজনের চেষ্টা করে। কিন্তু তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সময়ে বাংলাদেশের যুদ্ধ উপমহাদেশে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত লাভ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এক বিবৃতিতে উপমহাদেশের সংঘাতের জন্য মুখ্যত ভারতকে দায়ী করে। ৪ঠা ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জার নিরাপত্তা পরিষদের আহুত অধিবেশনে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি সম্বলিত মার্কিন প্রস্তাব পেশ করার প্রস্তুতি নেন। নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন শুরু হবার পর মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা, ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য স্ব-স্ব সীমান্তের ভেতরে ফিরিয়ে নেয়া এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবকে ক্ষমতা প্রদান করার জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি এই প্রস্তাবকে ‘একতরফা’ বলে অভিহিত করে ভেটো প্রয়োগ করেন। পোল্যান্ডও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। ফ্রান্স ও ব্রিটেন ভোট দানে বিরত থাকে। পরদিন ৫ই ডিসেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদের পুনরায় শুরু হওয়া অধিবেশনে সোভিয়েত ইউনিয়নের এক প্রস্তাবে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক ‘রাজনৈতিক নিষ্পত্তি’ প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘর্ষের অবসান নিশ্চিতভাবেই ঘটবে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সহিংসতার দরুন যে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে তাও অবলিম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন। একমাত্র পোল্যান্ড প্রস্তাবটি সমর্থন করে। চীন ভোট দেয় বিপক্ষে। অন্য সকল সদস্য ভোটদানে বিরত থাকে। ঐ দিন আরও আটটি দেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে আরও একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এবার সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয়বারের মত ভেটো প্রয়োগ করে। একই সময়ে ‘তাস’ মারফত এক বিবৃতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার ‘পূর্ব বাংলার জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে’ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানায়, এই সংঘর্ষ সোভিয়েত ইউনিয়ন সীমান্তের সন্নিকটে সংঘটিত হওয়ায় ‘এর সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত বলে উল্লেখ করে এবং পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে বিবাদমান পক্ষদ্বয়ের যে কোনটির সঙ্গে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য বিশ্বের সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন দেখল যে, জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার করা যাচ্ছে না তখন তারা নৌ কূটনীতির আশ্রয় নেয়। দেশটির উদ্দেশ্য ছিল- ভারতকে যুদ্ধবিরতি মানতে বাধ্য করা, পাকিস্তানকে রক্ষা করা, মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করা। ৯ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইউএসএস এন্টারপ্রাইজকে বঙ্গোপসাগরে মোতায়ন করেন, যাকে ভারত সরকার পরমাণবিক যুদ্ধ শুরু করার হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে। এন্টারপ্রাইজ ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর গন্তব্যে পৌঁছায়। যুক্তরাষ্ট্রের এই হুমকির জবাবে সোভিয়েত নৌ-বাহিনী ৬ ও ১৩ ডিসেম্বর নিউক্লিয়ার মিসাইলবাহী দুটি ডুবোজাহাজ ভাডিভস্টক থেকে বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করে, যারা ইউএস টাস্কফোর্স ৭৪-কে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত ভারত মহাসাগরে তাড়া করে বেড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য নৌ-যুদ্ধ পরিহার করার জন্য সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। সেদিন যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন নৌ-বহর প্রেরণ করে আমেরিকাকে সপ্তম নৌ-বহর প্রত্যাহারে বাধ্য না করতে পারত তাহলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জয়লাভ অনিশ্চিত হয়ে পড়ত। বাংলাদেশ হয়তো হতো ভিয়েতনাম অথবা নাইজেরিয়ার স্বাধীনতাকামী বায়াফ্রার মতো।
সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়া) ভূমিকা:
মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়। সোভিয়েতের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে তার প্রতিপক্ষ আমেরিকা ও চীনকে হীনবল করা সম্ভব হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে আশ্বাস দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র বা চীন যুদ্ধে সম্পৃক্ত হলে তারা এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আট দিনের মধ্যে তথা ২ এপ্রিল, ১৯৭১ সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নিকোলাই পডগোমী পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে একটি অনানুষ্ঠানিক পত্রের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন ও রক্তপাত চালানো হচ্ছে তা জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করার এবং বিদ্যমান সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আহ্বান জানান।
একটি পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরোপে তার প্রভাব বলয়ের মত এশিয়াতেও তার প্রভাব বৃদ্ধি করার জন্য পূর্বে পাকিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৬০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এশিয়ার জন্য তার যে নীতি প্রণয়ন করে তার ধারাবাহিতা রক্ষা করাই ছিল সোভিয়েতের এ যুদ্ধে জড়ানোর অন্যতম কারণ। সোভিয়েত ইউনিয়ন চাইতো না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ধারক নীতির মাধ্যমে এশিয়ায় প্রভাব বৃদ্ধি করুক। এছাড়াও ক্রমবর্ধমানহারে সামরিক, কুটনৈতিক এবং মতাদর্শগতভাবে শক্তিশালী চীন যাতে করে কিছুতেই দক্ষিণ এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারে সেজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষালম্বন করে। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন মনে করে, একটি বৃহৎ পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বের যে কোনো স্থানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তার রয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সামষ্টিক নিরাপত্তার ধারণাও এক্ষেত্রে কাজ করেছে। ১৯৬০ সালের শেষ দিকে ইউশোরী নদীকে কেন্দ্র করে চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। যে দ্বন্ধের প্রেক্ষিতে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান চীনের সহযোগিতা পাওয়ার কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সামষ্টিক নিরাপত্তার ধারণাকে মেনে নেয়নি। ১৯৬৭-১৯৬৮ সালে পাকিস্তান, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একত্রিত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি সাধারণ শত্রুতে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় ভারতের সঙ্গে মৈত্রীবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সোভিয়েত ইউনিয়নের নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য ছিল। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন একত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করলেও ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই উভয় দেশের মধ্য সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে, যখন সোভিয়েত নেতা বুলগালিন ও ক্রশ্চেভ দিল্লি সফর করেন। তবে এটিও সত্য যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে সু-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। অনেকের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করার অন্যতম কারণ ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া। এ সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে রাষ্ট্রকে সমর্থন দিত সোভিয়েত ইউনিয়ন সাধারণত তার প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রকে সমর্থন দিত।
১৯৭১ সালের প্রথম দিকে মস্কো চায়নি পাকিস্তান ভেঙে যাক। দেখা গেছে যে, ভারতে শরণার্থী সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে ত্যাগ করেনি। দেশটি এ সময় ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গেই সমানতালে সম্পর্ক বজায় রাখে। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে চীনের ভূমিকা কী হবে তা সোভিয়েত ইউনিয়ন পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমস্যা সমাধানে পাকিস্তানকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেয়। কিন্তু পাকিস্তান বিষয়টিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে জানায়। এ সময় বাংলাদেশ সোভিয়েতের নিকট সাহায্য চেয়ে যে চিঠি পাঠায় তা সোভিয়েত ফিরিয়ে দেয়। জুলাই পর্যন্ত দেশটি নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। জুলাই মাসে কিসিঞ্জারের চীন সফরের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভীত হয়ে পড়ে পাকিস্তান-চীন-যুক্তরাষ্ট্র একীভূত হয়ে গেছে ভেবে। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এ সম্পর্ক সোভিয়েতের জন্য সিদ্ধান্ত গস্খহণ করা সহজ হয়। ৯ আগস্ট সমষ্টিগত নিরাপত্তার নীতির আওতায় ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মস্কো সফর করে মস্কোর নিকট বাংলাদেশের যুদ্ধের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করে ব্যাপকভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১-১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে তিনবার ভেটো দেয়। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হতে চাচ্ছিল। উল্লেখ্য, পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
চীনের ভূমিকা:
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে চীন সরকার এ রকম মতামত প্রকাশ করে- ‘ভারত সরকারের দাবি তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য ভারত যুদ্ধ শুরু করেছে। ভারতের এই ধরনের দাবি প্রকৃতপক্ষে অযৌক্তিক। কারণ বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই অভ্যন্তরীণ সমস্যা রয়েছে, যেগুলো সঠিক ও যৌক্তিকভাবে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সমাধান করা দরকার। কিন্তু অন্য রাষ্ট্রের সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। কিন্তু ভারত পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে।’ এ ধরনের বক্তব্য থেকে ধারণা করা যায় যে, চীনের অবস্থান ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। তবে চীনের অবস্থান নেয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে, যা নিম্নে তুলে ধরা হলো।
পাকিস্তানের মত চীনের অভ্যন্তরেও ছিল বিভিন্ন জাতী-গোষ্ঠীর লোক। পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতি বা প্রদেশের জনগণ যদি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে ফেলে তাহলে চীনের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী নিজেদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা গড়ার অনুপ্রেরণা পাবে। তাই পাকিস্তান যাতে ভেঙে না যায় এবং চীনের জনগণের মধ্যে যাতে গোষ্ঠীভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চেতনা সৃষ্টি না হয় সেজন্য চীন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সহায়তা করে।
এশিয়া মহাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র ছিল ভারত। অপরদিকে পাকিস্তানের মিত্র ছিল চীন। এ দ্বৈত সম্পর্কের কারণে শক্তিসাম্য ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের একটি অংশ যদি ভেঙে ভারত ও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তাহলে শক্তিসাম্যের দিক দিয়ে চীন ও পাকিস্তান দুর্বল হয়ে যাবে এবং লাভবান হবে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।
চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বন্দ্বও এক্ষেত্রে কাজ করেছে। ১৯৬০ দশকের শেষ দিকে ইউশোরী নদী নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়। তখন থেকেই দুটি রাষ্ট্র ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করতে শুরু করে, যার প্রেক্ষিতে দেখা যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন যে রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করত তাহলে চীন বিপরীত রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করত।
১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধ শুরু হয়। এই সীমান্ত যুদ্ধে চীন একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ধারণা করেছিল যে, আরেকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সুবিধা পাবে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনকে সমর্থন না করে ভারতকে সহযোগিতা করে। এরফলে চীন বুঝতে পারে যে, আদর্শের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ। তাই চীন তার জাতীয় স্বার্থ পূরণ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের নেতাদের সম্পর্কে চীনের নেতাদের তেমন কোন স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। চীন মনে করত, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতের সম্প্রসারণবাদী নীতিরই অংশ। ১৯৫২ সাল থেকেই পাকিস্তান ছিল চীনের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। পাকিস্তানের স্থিতিশীলতার ওপরে চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনেকটা নির্ভর করত। তাই পাকিস্তানের অবস্থা যাতে অস্থিতিশীল না হয় এবং দ্বিখণ্ডিত না হয়Ñসে অবস্থা নিশ্চিত করতে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ছিল বৈরিতাপূর্ণ। ৭০-এর দশকে এ দুটি বৃহৎ শক্তির মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে পাকিস্তানের নেতৃত্বের আন্তরিক সহযোগিতার মাধ্যমে।
১৯৭১ সালের এপ্রিলে চীন প্রথম প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে আখ্যায়িত করে এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য কারো হস্তক্ষেপ চীন সহ্য করবে না বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে।
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে চীনের সমর্থন আদায়ে ভূট্টো চীন সফর করেন। ভুট্টো মনে করতেন, চীন এ যুদ্ধে জড়ালে তাদের সক্ষমতা বাড়বে। এ সময় চীন পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণভাবেই এ সমস্যার সমাধান করার আহ্বান জানায়। ২১ নভেম্বর ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে এবং সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় চীন জাতিসংঘের অধিবেশনে ভারতকে দায়ী করে। ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্প্রসারণ নীতি নিয়ে চীন অনেক চিন্তিত ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শেষ বিবৃতিতে চীন বলে, ‘ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় যে সমস্যা সৃষ্টি করছে তার ফল সে ভোগ করবে।’ তবে আপাতদৃষ্টিতে ১৯৭১ সালে চীনকে পাকিস্তÍান ঘেষা মনে হলেও আসলে তা ছিল তার নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার নীতি।
শেষকথা:
১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। কেননা ঠান্ডাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ যে দেশটি যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। তাই মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জনসাধারণের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হলেও ঠাণ্ডাযুদ্ধের কারণে সেটি আন্তর্জাতিক মাত্রা পায়। এর বড় প্রমাণ হচ্ছে এই যে, পাকিস্তানের পক্ষে তথা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রকাশ্যে অবস্থান গ্রহণ, অন্যদিকে মুক্তিকামী বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সুস্পষ্ট সমর্থন জানায়। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন বা বিরোধিতা যতটা না ছিল বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বৃহৎ শক্তিগুলোর নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা। বস্তুত, তৎকালীন দু পরাশক্তির মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রতিফলিত হয়।
সামহোয়ারইনব্লগ ডটকম, ৩০ মার্চ, ২০১০