জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৬২ বছর: সাফল্য ও ব্যর্থতার খতিয়ান

জাতিসংঘ বিশ্বের জাতিসমূহের একটি সংগঠন, যার লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পরস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। সংস্থাটি ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব নেতারা যুদ্ধ বন্ধ এবং শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য লিগ অব নেশন্স গঠন করেন। সংঘর্ষ ও উত্তেজনা রোধে সংস্থাটি কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। ১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলা এবং সৃষ্ট মানবতার বিপর্যয় বিশ্ব নেতাদের শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। ফলে একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় নানা ধরনের পদক্ষেপ গৃহীত হয় এবং লিগ অব নেশন্স-এর ধ্বংস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। কোনো একটি সময় বা ঘটনার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং ১৯৪১ সালের জুন থেকে ১৯৪৫ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্ব নেতাদের নানা প্রচেষ্টায় এবং গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘ শব্দটির প্রবর্তক হলেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট। জাতিসংঘ একটি রাজনৈতিক সংগঠন। এর ব্যাপক কর্মপ্রক্রিয়া মূলত রাজনীতির বৃত্তেই প্রস্ফুটিত। জাতিসংঘ সনদের প্রস্তাবনা এবং ১নং অনুচ্ছেদে সংস্থাটির উদ্দেশ্যসমূহ বর্ণিত হয়েছে এভাবে- ১. বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা, ২. পৃথিবীর স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, ৩. মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যাবলী নিরসনের দ্বারা সৃষ্ট বাধ্যবাধকতার প্রতি সুবিচার ও সম্মান প্রদর্শন করা এবং জাতিসংঘকে রাষ্ট্রসমূহের ক্রিয়া-কলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা। সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, সচিবালয়, ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক আদালত এ ছয়টি প্রধান সংস্থা এবং বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা নিয়ে জাতিসংঘ গঠিত।

জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৬২ বছর (২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী) অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংস্থাটির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সদস্য দেশগুলোর পরস্পরের প্রতি সন্দেহ এবং অবিশ্বাস জাতিসংঘের স্বাধীন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতিসংঘ কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দিয়েছে, আবার অনেক ক্ষেত্রেই দিয়েছে ব্যর্থতার পরিচয়। সংস্থাটির বর্তমান ব্যর্থতা আর অকার্যকারিতার জন্য এর সাংগঠনি কাঠামো, প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাসহ বৃহৎ শক্তিগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ককে দায়ী করা হয়।

৬২ বছরের ইতিহাসে জাতিসংঘের সফলতার পরিসংখ্যান একেবারে কম নয়। ১৯৪৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত সংস্থাটি ১৭২টি (২০০৮ সাল পর্যন্ত) সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এতে অবসান হয়েছে অনেক আঞ্চলিক সংঘাতের। জাতিসংঘ তার নীরব কূটনীতির মাধ্যমে ৮০টিরও বেশি আসন্ন যুদ্ধ এড়াতে সক্ষম হয়েছে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংস্থাটির মূল্যবোধ ও কার্যকর পদক্ষেপের কারণে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে বড় ধরনের কোনো সংঘাত হয়নি। সংস্থাটি ৫০টিরও বেশি দেশের স্বাধীনতা অর্জনে পালন করেছে সক্রিয় ভূমিকা। নব্বইয়ের দশকে নামিবিয়া, এলসালভেদর, মোজাম্বিক ও কম্বোডিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবদান উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের উদ্যোগে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। দু বার বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে জাতিসংঘ।

১৯৫০ সালে সৃষ্ট কোরিয়া সংকট, ১৯৫৬ সালে সৃষ্ট সুয়েজ সংকট, এবং কঙ্গো ও সাইপ্রাস সংকট নিরসনে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ইরান-ইরাক যুদ্ধ অবসানে জাতিসংঘ ১৯৮৭ সালের ২৫ জুন ৫৯৮নং প্রস্তাব গ্রহণ করে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরে দু দেশকে সহযোগিতা করে। নামিবিয়া ও পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৩ সালের মধ্যপ্রাচ্য সংকট, ১৯৯১ সালে ইরাক-কুয়েত সংকট, ১৯৯২ সালে বসনিয়া হার্জেগোভিনায় এবং সোমালিয়ায় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করায় জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় ১৯৮৮ সালে এ বাহিনীকে দেয়া হয় নোবেল পুরস্কার। এছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ ও নিরস্ত্রীকরণে জাতিসংঘের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন ১৯৪৮ সাল থেকে আজ অবধি বিশ্বে স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

সফলতার পাশাপাশি জাতিসংঘের ব্যর্থতাও কম নয়। স্নায়ুযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতের জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে জোরেশোরে। জতিসংঘ আসলে বিশ্বব্যাপী বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা পারবে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ফিলিস্তিন-ইসরাইল সমস্যার সমাধান করতে না পারাকে জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ সমস্যা সমাধানে শুধু প্রস্তাব গ্রহণ করেই জাতিসংঘ ক্ষান্ত থেকেছে। লেবানন সংকট নিরসনে শুধু শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠন করেই জাতিসংঘ তার দায়িত্ব শেষ করেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ১৯৪৮ সালে বার্লিন সমস্যা, ১৯৬২ সালে কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস নিরসনে জাতিসংঘ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। কসোভো ও বসনিয়া হার্জেগোভিনার যুদ্ধ বন্ধের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

জাতিসংঘ যদিও অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের মাধ্যমে সামাজিক ও অথনৈতিক উন্নয়নে তৎপর, কিন্তু বৃহৎ শক্তিগুলোর চাপ ও প্রাধান্য বিস্তারের প্রচেষ্টা এক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘ অনেকটাই বৃহৎ শক্তিগুলোর ক্রীড়ানকে পরিণত হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার, জাতিসংঘ সনদের তোয়াক্কা না করা এবং সাধারণ পরিষদকে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলার মানসিকতার কারণে জাতিসংঘ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন একতরফা হামলায় জাতিসংঘ দর্শকের ভূমিকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থা ও ন্যাটোর মত সামরিক সংগঠন জাতিসংঘের ওপর বিভিন্নভাবে প্রভাব তৈরি করেছে, যা সংগঠনটির স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে।

বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ব আজ উন্নত ও অনুন্নত এই দু শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে আছে। এ অবস্থায় পৃথিবীব্যাপী সংঘাত, দারিদ্র্য ও এইডসের মত ভয়াবহ ব্যাধি মোকাবিলায় জাতিসংঘের কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। পরিবর্তিত এ বিশ্ব ব্যবস্থায় জাতিসংঘের ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই সংস্থাটির প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তথা বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় সংস্থাটি আরও বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করবে Ñ এটাই সবার প্রত্যাশা।

যায় যায় দিন, ২৪ অক্টোবর ২০০৮

Leave a Reply

Your email address will not be published.