সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সিটি নির্বাচন নিয়ে সংশয়

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশের পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন। গাজীপুরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৫ মে, আর অন্য চারটির — খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট — নির্বাচন জুন মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনগুলো আয়োজন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে করা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচনগুলো হতে পারে জাতীয় নির্বাচনের আগের মহড়া। নির্বাচন কমিশন কেমন জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হবে এবং সরকার এক্ষেত্রে কমিশনকে কেমন সহায়তা করবে, কিংবা প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচনে কেমন ভূমিকা পালন করবে তার কিছুটা আঁচ এই নির্বাচনগুলোতে পাওয়া যাবে।

অন্যদিকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ও দায়বদ্ধ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে ‘লোকাল ডেমোক্রেসি’ প্রতিষ্ঠার জন্য উপরোক্ত সিটি নির্বাচনগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে জাতীয়ভাবে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথে কিছুটা হলেও আমরা এগিয়ে যাব। এছাড়াও আমাদের সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একটি স্বায়ত্বশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা, যারা ‘পাবলিক সার্ভিস’ বা সকল জনকল্যাণমূলক সেবা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত সকল পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবেন। দুর্ভাগ্যবশত স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত এমন গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ম্যান্ডেট আমাদের আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত।

আমরা মনে করি, কমিশন যদি সত্যিকার অর্থেই সুষ্ঠুভাবে সিটি নির্বাচন করতে চায়, তাহলে প্রথমত নির্বাচনের প্রত্যেকটি ধাপ বা প্রক্রিয়া সঠিক কিনা হওয়া তা নিরুপণ করতে হবে। আর আমরা জানি, প্রত্যেকটি নির্বাচনী ধাপের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে কতগুলো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ওপর। এগুলো হলো: ১. যথাযথ আইনি কাঠামো; ২. ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়ায় যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য ছিলেন তারা ভোটার হতে পেরেছেন; ৩. যারা প্রার্থী হতে চেয়েছেন তারা প্রার্থী হতে পেরেছেন; ৪. ভোটারদের সামনে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থী ছিল; ৫. যারা ভোট দিতে চেয়েছেন তাঁরা ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে ওঠে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছেন; ৬. অর্থ কিংবা সহিংসতার মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল; ৭. ভোট গণনা সঠিকভাবে হয়েছে; সর্বোপরি, ৮. ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া ছিল স্বচ্ছ, কারসাজিমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য।

কিন্তু কমিশন এই মানদণ্ডগুলো অনুসরণ করে সিটি নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমাদের সংশয় রয়েছে। কারণ দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো এই নির্বাচন বর্জন করায় ভোটারদের সামনে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থী থাকা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এরফলে নির্বাচনগুলো হয়ে ওঠবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। অন্য অর্থে বলতে গেলে নির্বাচনগুলো হবে মূলত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে। যদিও ক্ষমতাসীন দল তাদের পুরানো কৌশলের অংশ হিসেবে জাতীয় পার্টি ও চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে নির্বাচনে মাঠে রেখে নির্বাচনগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু নির্বাচনী মাঠে বিএনপির অনুপস্থিতি এবং কমিশন তথা নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি ভোটারদের অনাস্থার কারণে ভোটের অতি নিম্নহার পরিলক্ষিত হলে সরকারের এই কৌশল সফল নাও হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, এই নির্বাচনে ভোটাররা ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে ওঠে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। এক্ষেত্রেও সরকার পুরানো কৌশল অবলম্বন করতে পারে। আমরা দেখেছি, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশনগুলো নির্বাচন ছিল তথাকথিত ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচন। সে সময় নির্বাচনে ‘খুলনা মডেল’ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল। সে নির্বাচনে দৃশ্যত ব্যাপক এলাকাজুড়ে বড় কোনো ধরনের অঘটন ও সহিংসতা ছাড়া অনুষ্ঠিত হলেও নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কেননা, অনেক ভোট কেন্দ্রে বিরোধী দলের পোলিং এজেন্ট না থাকা, কেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদান, সিল-স্বাক্ষরবিহীন ব্যালটে প্রদত্ত ভোটকে বৈধ ভোট হিসেবে গণ্য করা, কেন্দ্রের সামনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর কর্মী কর্তৃক জটলা সৃষ্টি করে কোনো কোনো ভোটারের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। অনেক ভোটার তাদের ভোট দিতে না পারা, নির্বাচনের আগ থেকেই বিরোধী দলের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতার ও হয়রানি করা, রিটার্নিং অফিসারের ওপর যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে সহায়তাকারী হিসেবে নিয়োগ করা ইত্যাদি ঘটনাবলি ঐ নির্বাচনকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। সে সময় খুলনার পর গাজীপুরেও একই মডেলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

তৃতীয়ত, দলীয়ভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি চরম প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয়ভিত্তিক নির্বাচনের কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একদিকে যেমন প্রার্থীর সংখ্যা কমে গিয়েছে এবং প্রার্থীর মানে অবনতি ঘটেছে, একইসঙ্গে সরকারি দলের প্রতীক প্রাপ্ত প্রার্থীদের নির্বাচনে জেতার পথ সুগম হয়েছে।

আমরা মনে করি, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো নির্বাচন কমিশনের জন্যও এক অগ্নিপরীক্ষা। কিন্তু নানাবিধ বিতর্কিত কর্মকা-ের কারণে বর্তমান কমিশন ইতিমধ্যেই তার আস্থা হারিয়েছে। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন স্থগিত না বাতিল ছিল তা নিয়ে গোজামিলের আশ্রয় নেওয়া, নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত রাঘববোয়ালদের অব্যাহতি দিয়ে শুধু চুনোপুটিদের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং নিজের শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা না করা।

আরেকটি বিতর্কিত কাজ হলো আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া। আমাদের আশঙ্কা যে, এটি কমিশনের আস্থার সংকট কাটানোর ব্যাপারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ ইভিএম কারিগরিভাবে একটি দুর্বল ও কারিসাজির যন্ত্র এবং এর ব্যবহারের মাধ্যমে বেড়াই ক্ষেত খেতে পারার অভিযোগ একেবারেই অমূলক নয়। এর অন্যতম কারণ হলো আমাদের ইভিএমে ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) না থাকা, মেশিন হ্যাঙ করা, আঙ্গুলের চাপ শনাক্ত করতে না পারা, চূড়ান্ত ভোট গণনা ম্যানুয়ালি করা ইত্যাদি। আমাদের ইভিএমে ভিভিপিএটি না থাকায় ভোটের ফলাফল বদলিয়ে দিয়ে পরাজিত করার হিরো আলমের অভিযোগ যে সঠিক নয় তা ফলাফল পুনঃগননার মাধ্যমে কমিশন প্রমাণ করতে পারেনি, বরং কমিশনের প্রদত্ত ফলাফলকেই চূড়ান্ত বলে ধরে নিতে হয়েছে। প্রসঙ্গত, এ দুর্বলতা কাটাতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তাদের ব্যবহৃত ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করতে নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করেছে। তাই এ দুর্বল, বিতর্কিত ও জাতীয় নির্বাচনের জন্য বাতিল যন্ত্র নির্বাচন কমিশন কেন আসন্ন সিটি করপোরেশ নির্বাচনে ব্যবহারের ঝুঁকি নিল তা আমাদের বোধগম্য নয়।

কমিশন যে ইতিমধ্যেই ভোটারদের আস্থা হারিয়েছে তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম-১২ উপনির্বাচনে। আমরা মনে করি, সে নির্বাচনে গোপন কক্ষে ‘ডাকাতের’ উপদ্রব, কেন্দ্র দখল এবং মাত্র ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশের (২১টি কেন্দ্রে ২-৫ শতাংশের, ৫২টি কেন্দ্রে ৫-১০ শতাংশের) কম ভোটার উপস্থিতি পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ওপর ভোটারদের আস্থাহীনতারই প্রতিফলন। এখন দেখার বিষয় আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন এ আস্থার সংকট কাটিয়ে ওঠতে পারবে কিনা।

আমরা মনে করি, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলো নির্বাচন কমিশন। সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব হলো এক্ষেত্রে কমিশনকে সহায়তা করা। আমরা দেখেছি, সরকারের সদিচ্ছার কারণেই দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি নির্বাচন কিংবা ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। একইভাবে আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার মাধ্যমে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে তার একটি জোরালো বার্তা সরকার দিতে পারে। দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমলে নিলে এ বার্তার ওপর আস্থা রাখা যায় না। তাই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সিটি নির্বাচন আয়োজন নিয়ে যে সংশয় রয়েছে এ নিয়ে আর সন্দেহ থাকার কথা নয়।

১৫ মে ২০২৩

Leave a Reply

Your email address will not be published.