১৯৭২ সালে মাত্র ১৮২ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। দীর্ঘকাল যাবত একটি রাষ্ট্র্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিডিবি সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু ৯০ এর দশকের পর থেকে বিশ্বব্যাংকের নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পিডিবি ধীরে ধীরে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালের পর সরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র্র স্থাপনের সংখ্যা হ্রাস পায় উল্লেখযোগ্য হারে, বেড়ে যায় বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সংখ্যা। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী, পিডিবি কর্তৃক পরিচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ৫৮টি। অন্যদিকে বেসরকারি এবং বিদেশি কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ২৭৮টি। সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ২০১১ সালে পিডিবিকে ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে হবে বেসরকারি খাত থেকে। ফলে পিডিবি পরিণত হবে বিদ্যুৎ কেনাবেচার প্রতিষ্ঠানে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত বেসরকারিকরণ
একাত্তরের পর সরকার শিল্পকারখানা জাতীয়করণের নীতি গ্রহণ করে, যার বিরোধিতা করে বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। আশির দশকে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস প্রকল্প (স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রজেক্ট-স্যাপ) গ্রহণ করে বাংলাদেশ। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারি খাতগুলো বেসরকারিকরণ, বাণিজ্য উদারীকরণ এবং বহুজাতিক কোম্পানির হাতে সেবা খাত তুলে দেয়া। এই নীতির আওতায় বিদ্যুৎ খাত বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া প্রথম শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। সে বছর সরকার বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ ও পরামর্শে বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি অনুমোদন করে এবং ‘বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি’ (প্রাইভেট পাওয়ার জেনারেশন পলিসি) প্রণয়ন করে। এর মাধ্যমেই বিদ্যুৎ খাত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার প্রথম সফল উদ্যোগ নেয়া হয়। রাষ্ট্র্রীয় খাত থেকে আলাদা বিদ্যুৎ উৎপাদক তৈরি করা (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার-আইপিপি) হিসেবে বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে নতুন উৎপাদন ক্ষমতা তৈরি করা ছিল এর উদ্দেশ্য। এ নীতিতে পিডিবির উৎপাদন সম্পদকে বাণিজ্যিকীকরণ এবং মুনাফা কেন্দ্র স্থাপন, বিতরণ ইউনিটগুলোকে করপোরেশনে রূপান্তর ও বাণিজ্যিকীকরণ, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের জন্য সুযোগ তৈরির উদ্দেশ্যে নির্বাচিত মুনাফা সেন্টারের পুনর্বাসন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রদানের কথা বলা হয়। পিডিবিকে পুনর্গঠন ও করপোরেশনভিত্তিক উৎপাদন, আলাদা সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিশ্বব্যাংক ও এডিবি’র সঙ্গে একমত হয়ে বাংলাদেশ সরকার নানা উদ্যোগ নেয়।
ডেসা গঠন: বিতরণ ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের প্রথম উদ্যোগ
ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা ১৯৯১ সালের ১ অক্টোবর ‘ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই অথরিটি’ (ডেসা) প্রতিষ্ঠা করা হয়। পুরো বাংলাদেশে তখন বিদ্যুতের চাহিদা ছিল তিন হাজার মেগাওয়াট। ঢাকায় তখন চাহিদা ছিল ১৮০ মেগাওয়াট। এই ১৮০ মেগাওয়াট নিয়ে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করার দরকার আছে কিনা তা নিয়ে তখন প্রশ্ন ওঠে। বিশ্বব্যাংক ও সরকার তখন বলে যে, এতে সিস্টেম লস কমবে এবং বিতরণ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়বে। ডেসা করার আগে ঢাকার বিদ্যুৎ বিতরণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দরকষাকষির আলোচনায় সরাসরি পিডিবি বসত। আর ডেসা করার পর ঢাকার বিদ্যুৎ বিতরণ নিয়ে বিশ্বব্যাংক শুধু ডেসার সঙ্গে বসার সুযোগ পায়। ডেসা যেহেতু ছোট ও দুর্বল সংস্থা, তাই এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক তার নীতি বাস্তবায়ন সহজ উপায় পেয়ে যায়। সে সময় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির ব্যয় ছিল গড়ে ২ টাকা ১০ পয়সা। আর গড় আদায় ছিল সাড়ে ৩ টাকা। অথচ ডেসাকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় ১ টাকা ৫৮ পয়সায়। ডেসা সাড়ে ৩ টাকায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি শুরু করে। কিন্তু ২৫ থেকে ৪০ ভাগ সিস্টেম লসের কারণে ডেসা লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ডেসা এক যুগ ধরে অব্যাহতভাবে লোকসান দিয়ে গেছে। কম দামে বিদ্যুৎ কিনে বেশি দামে বিক্রি করলেও ছয় হাজার কোটি টাকা লোকসান দেয়। অবশেষে ২০০৮ সালের জুন মাসে ডেসা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ডেসা ভেঙ্গে কোম্পানি – ডেসকো
যে উদ্দেশ্যের কথা বলে পিডিবির বাইরে নতুন সংস্থা ডেসা গঠিত হয় সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ডেসা গঠিত হওয়ার পর এতে চরম দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ডেসার সমালোচনা শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মধ্যেই ডেসার একটি অংশ বনানী, গুলশান, মিরপুর ও উত্তরা নিয়ে ‘ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি-ডেসকো নামে একটি নতুন কোম্পানি গঠন করা হয়। ১৯৯৬ সালে ঢাকায় তখন চাহিদা ছিল ছয় শ’ মেগাওয়াট। দেখা গেছে, তখন মাত্র তিনশত মেগাওয়াট নিয়ে ডেসকো দাঁড় করানো হয়।
ডেসা বিলুপ্ত করে ডিপিডিসি
ডেসার বিশাল টাকার দায় অমীমাংসিত রেখেই ১ জুলাই ২০০৮ সালে গঠিত হয় ‘ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড’ (ডিপিডিসিএল)। ডেসার বাকি অংশ ঢাকার দক্ষিণাঞ্চল ও নারায়ণগঞ্জ নিয়ে কোম্পানিটি গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে পিডিবির কাছ থেকে কেনা বিদ্যুতের পুরো দাম পরিশোধের পর ডেসা আমলের বকেয়াও পরিশোধ করছে।
রাজধানী ঢাকায় এখন ডেসকো ও ডিপিডিসি প্রতিষ্ঠান দুটি বিদ্যুৎ বিতরণ কাজে নিয়োজিত। পৃথিবীতে এমন কোন নজির নেই যেখানে একই শহরে পাঁচ শ’-পাঁচ শ’ মেগাওয়াট নিয়ে দুটি সংস্থা আছে। একমাত্র মুম্বাই হলো ব্যতিক্রম। সেখানে অনেক আগ থেকে পর্তুগিজরা ছিল বলে সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থার পাশাপাশি আগেকার একটি বেসরকারি কোম্পানি রয়েছে।
ট্রান্সমিশনের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছে পিজিসিবির কাছে
বিদ্যুৎ খাত সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২১ নভেম্বর ১৯৯৬ সালে গঠন করা হয় ‘পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ-পিজিসিবি’। ৩১ ডিসেম্বর ২০০২ সালে পিডিবির সম্পূর্ণ ট্রান্সমিশন (সঞ্চালন ব্যবস্থাপনা) পিজিসিবির নিকট হস্তান্তর করা হয়। তবে পিডিবি কোম্পানিটির ৭৫ ভাগ শেয়ারের মালিক। এর লাভ কিংবা লোকসান দুটোই পিডিবি পায়। পিজিসিবি কার্যক্রম শুরু করে ২০০৩ সালে। পিজিসিবি বর্তমানে বেশকিছু সমস্যার মুখে। যেমন, এর বেশকিছু সঞ্চালন লাইন পুরানো, যেগুলো সংস্কারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এছাড়া বেশকিছু লাইন রয়েছে (ওভারলোডেড), যেখানে পাঁচ জন গ্রাহকের জায়গায় ১০ জন গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড গঠন হয় যে কারণে
ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি-আইডিএ এবং বিশ্বব্যাংকের আরেকটি প্রকল্প ছিল বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-আরইবি। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ বহাল থাকলেও ১৯৭৭ সালের ৫১নং পল্লী বিদ্যুৎ অধ্যাদেশ দিয়ে পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড গঠন করা হয়। অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটি গঠিত হলেও আগের আদেশ লঙ্ঘন করে পিডিবির সম্পদ এই অর্ধ স্বায়ত্তশাসিত বোর্ডকে হস্তান্তর করা হয়। এই বোর্ডের কাছে পিডিবির কয়েক হাজার কিলোমিটার বিদুতের লাইন তুলে দেয়া হয়। পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড নিজে কোনো উৎপাদন করে না। সংস্থাটি পিডিবির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে গ্রামাঞ্চলে সরবরাহ করে। পিডিবির কাছ থেকে প্রতি কিলোওয়াট দু টাকায় বিদ্যুৎ কেনে তা চার টাকায় বিক্রি করে। শহরাঞ্চলের মানুষের চেয়ে গ্রামের মানুষ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে বেশি দাম পরিশোধ করে। বিদ্যুৎ সরবরাহ যদি নাও থাকে তবু গ্রাহককে বিল পরিশোধ করতে হয়। এটি উল্লেখ করার বিষয় যে, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি যে কাজগুলো করছে তা পিডিবিই করতে পারতো। শুধুমাত্র পিডিবিকে দুর্বল করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন।
বাস্তবায়িত হয়নি ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান’
১৯৮৫ সাল ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পিডিবি অনুধাবন করে যে, দেশে আরও অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা দরকার। ২০১০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ছয় হাজার মেগাওয়াট – তখন এটা ধরে নেয়া হয়। সেই লক্ষ্য থেকেই পিডিবি ১৯৮৫ সালে পরবর্তী ২৫ বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করে। এতে বলা হয়, প্রতিবছর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে এবং প্রতি পাঁচ বছর পরপর এটি পরিবর্ধন করা হবে। এরপর ১৯৯০, ৯৫ এবং ২০০৫ সালে এটি পর্যালোচনা করা হয়। কিন্তু বিগত সরকারগুলোর যথাযথ ও সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে আজ পর্যন্ত ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান’ কোনদিন বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০৬ সালে পুনরায় ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এটিও সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
দাম বেড়েছে বিদ্যুতের: ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ
পিডিবির অধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে এক টাকা ৬০ পয়সা খরচ হয়। অথচ পিডিবি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনে চার টাকায়। বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার ফলে পিডিবি ইতোমধ্যে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে ভাড়াভিত্তিক এবং স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র-আইপিপি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্র থেকে কেনা বিদ্যুতের দাম বেশি দেখিয়ে জনগণের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। বার বার বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পিডিবি খুব একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে না পারলেও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী কয়েক দফা বাড়িয়েছে বিদ্যুতের দাম। নতুন ভাড়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনে আসার কারণে বিদুতের দাম বাড়ানো হবে বারবার, এতে নেই কোনো সন্দেহ।
পিডিবির বর্তমান সমস্যার ধরন
পিডিবির বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ৩৩ শ’ মেগাওয়াট হলেও অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ২ হাজার থেকে ২৩ শ’ মেগাওয়াট। পিডিবির আওতাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রায় ৪০ ভাগই ২০ বছরের অধিক পুরানো। কিছু কিছ কেন্দ্র আছে ৪০ বছরেরও বেশি পুরানো। এ কেন্দ্রগুলো প্রায়ই বন্ধ থাকে। যেসব কেন্দ্রে যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে আছে সেগুলোকে মেরামত করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। মাঝেমাঝে বিদেশি কিছু বিশেষজ্ঞ ডাকা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামত করার জন্য। দেশীয় বিশেষজ্ঞদের ডাকা বা বিশেষজ্ঞ তৈরির কোনো উদ্যোগ পিডিবির নেই, যে কারণে জরুরিভিত্তিতে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব হয় না। পুরানো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে নবায়ন করা গেলে সেখান থেকে ছয় শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। বিভিন্ন ভোল্টেজ লেভেলে যথাযথ মানের ক্যাপাসিটর বসানো হলে সিস্টেমে প্রায় ২৫০ মেগাওয়াট ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পাবে।
রাজনৈতিক ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে পিডিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা জানান, ‘পিডিবির অধীন কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন কম হওয়ার কারণ হলোÑ টেকনিক্যাল, ট্রান্সমিশন ও বিদ্যুৎ গ্রিডের সমস্যা ও সিস্টেম লস। গ্যাসের সরবরাহের অভাবে বর্তমানে কমপক্ষে আট-নয় শ’ মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এ কারণে পিডিবির টাকা এবং যাবতীয় সহায়তা নিয়ে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মুনাফা ও আকার বাড়ছে।’
গ্যাস সংকটে গত কয়েক মাসে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ না করে স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র-আইপিপি এবং ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র-আরপিপি কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে সেগুলো চালু থাকছে। কম দামে যেখানে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়Ñসেখানে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে না।
নতুন কেন্দ্র তৈরির সমস্যা
দেশে গত দু বছরে বিভিন্ন মেয়াদি ১১টি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র-আরপিপি স্থাপিত হয়েছে। একইভাবে গত পাঁচ বছরে বেসরকারি বিনিয়োগে আইপিপি নির্মিত হয়েছে ১৩টি। এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা দেড় হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। অথচ এ সময়ে সরকারি অর্থায়নে পিডিবি পরিচালিত নিজস্ব কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে মাত্র তিনটি। প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার পিডিবির আরও চারটি কেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে নানাভাবে। এ কেন্দ্রগুলো সময়মতো স্থাপন করা গেলে বেসরকারি ওইসব কেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য হত না পিডিবি।
পিডিবি কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন যে, নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্প করার জন্য তাদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় মোটা অংকের টাকা সরকারের হাতে নেই। এ বিষয়ে ‘তেল-গ্যাস, খনিজ, বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র সদস্য সচিব ড. আনু মোহাম্মদ রাজনৈতিক ডটকমকে জানান, ‘বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন মাত্র ১৭ হাজার কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেই অলস পড়ে রয়েছে এরচেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ টাকা। সরকার পিডিবি জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারছে না, কিন্তু ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশি কোম্পানির জন্য বরাদ্দ দিচ্ছে। সেই ঋণের ভার পড়ছে জনগণের ওপর। এটা বিশ্বব্যাংকের নীতির অংশ যে, পিডিবির জন্য টাকা বরাদ্দ দেয়া যাবে না। বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার ক্ষেত্রেও একই নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে।’
পিডিবি পরিণত হচ্ছে বিদ্যুৎ কেনাবেচার প্রতিষ্ঠানে
৯০’র দশকের শেষভাগ থেকে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অর্থ দেবে না বলে জানায়। এরফলে সরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। আইপিপি নামে বিদেশি কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে পিডিবি প্রথম বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেনা শুরু করে। সে বছর পিডিবি বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কিনে ৩০২ মেগাওয়াট, যা এ সময়ের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১১ শতাংশ। ধীরে ধীরে এ কেনার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৯ সাল নাগাদ দাঁড়ায় ৩০ শতাংশে। আগামী এক বছরের মধ্যে ভাড়াভিত্তিক আরও ১ হাজার ৫ শ’ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে ২০১১ সালের মধ্যে মোট ৩,৩০০ থেকে ৩,৫০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি। এরফলে তখন পিডিবির বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ দাঁড়াবে ৬০ শতাংশের ওপরে। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে পিডিবি কর্তৃক গৃহীত পরিকল্পনা অনুসারে দেখা যায়, ২০১৫ সাল নাগাদ সরকারি খাতে ৩,৬৮০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। একই সময়ের মধ্যে বেসরকারি খাতে ৫,৭ ৪৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। ফলে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পিডিবি পরিণত হতে চলেছে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনাবেচার প্রতিষ্ঠানে।
জ্বালানি মন্ত্রনালয়ের অন্তর্ভুক্ত পাওয়ার সেল-এর সাবেক মহাপরিচালক বি.ডি. রহমতুল্লাহ এ বিষয়ে রাজনৈতিক ডটকমকে জানান, ‘একটি প্রতিষ্ঠান যখন বৈরিতার সম্মুখীন হয় এবং তার বিকশিত হওয়ার রাস্তা যদি বন্ধ হয়ে যায়, তখন অনিয়ম ও দুর্নীতি বাড়ে। পিডিবির ক্ষেত্রে ঘটেছে তাই। বিশ্বব্যাংকের দীর্ঘদিনের একটা নীতি ছিল এই রকম যে, বিদ্যুৎ খাতে কেন্দ্রীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিতে হবে। আর সেটি সম্ভব হলে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া সহজ হবে। উন্নয়ন, লাভ এবং কম খরচ ইত্যাদি আওয়াজ তুলে সম্পূর্ণভাবে বিদ্যুৎ খাতকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দেয়াই ছিল এক্ষেত্রে এখানে বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্য। পিডিবির অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যই আজ সফল হতে চলেছে।’
রাজনৈতিক ডটকম, ১২ অক্টোবর ২০১০