দীর্ঘদিন ধরে ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। অনবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষ করে গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে সরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেগুলোর ফল পেতে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু বর্তমান সংকট কাটানোর জন্য অনবায়নযোগ্য জ্বালানির মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশে বছরে গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ দিন সূর্যালোক থাকে। প্রতিদিন প্রায় পাঁচ কিলোওয়াট ঘণ্টা শক্তি এদেশের প্রতি বর্গমিটার জমিতে আছড়ে পড়ছে। ভূপতিত এই সৌরশক্তির মাত্র ০.০৭% শক্তিতে রূপান্তর করা গেলেই বাংলাদেশের সব বিদ্যুতের চাহিদা মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হবে। সোলার প্যানেল স্থাপনে প্রাথমিক বিনিয়োগ অনেক বেশি হলেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নূন্যতম কিছু খরচ ছাড়া আর তেমন খরচ হয় না। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন হয় খুব সহজেই। সূর্যের আলোর কণা সোলার মডিউলে পড়লেই সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এ বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে জমা হয়। সোলার হোম সিস্টেমে চার্জ কন্ট্রোলার ব্যাটারিকে অতিরিক্ত চার্জ ও ডিসচার্জ হওয়া থেকে রক্ষা করে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ বিতরণ করে।
বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ৮১ শতাংশই আসে সৌরবিদ্যুৎ থেকে। বর্তমানে দেশে মোট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ২০ মেগাওয়াট। এরমধ্যে দেশে উৎপাদিত সৌর প্যানেল থেকে পাওয়া যায় ৫ মেগাওয়াট আর আমদানি করা সৌর প্যানেল থেকে ১৫ মেগাওয়াট। এই ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মোট উৎপাদনের ০.৬ ভাগ। গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৪০ লাখের মত মানুষ এখন সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে উপকৃত হচ্ছে।
ঢাকা মহানগরী ও সৌরবিদ্যুৎ
ঢাকা শহরে প্রায় এক লাখ ৭৮ হাজার ভবন আছে। যেখানে সোলার প্যানেল বসিয়ে ১,৪৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশ ডিজেল প্ল্যান্ট (বিডিপি) লি. থেকে পাওয়া এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, একটি পাঁচ কিলোওয়াটের সোলার প্যানেল স্থাপন করতে প্রাথমিকভাবে ১৩ লাখ টাকা প্রয়োজন হয়। আর এরজন্য প্রয়োজন তিন থেকে চার কাঠা জমির ওপর নির্মিত ভবনের ছাদ। ঢাকা নগরীতে যত ইমারত, তার অর্ধেকের ছাদ ব্যবহার করে এভাবে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
বিশ্বব্যাপী সৌরবিদ্যুৎ
ইউরোপের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সংগঠন ‘ইপিআইএ’-এর ২০০৯ সালের এক হিশাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ২০ হাজার মেগাওয়াট। ২০০৮ সাল থেকে ২০০৯ সালে বিশ্বজুড়ে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে ৪৪ ভাগ। উন্নত দেশগুলো প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে থাকলেও, সৌর বিদ্যুতের জনপ্রিয়তা বেশি বেড়েছে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বিশেষভাবে চীন, ভারত ও বাংলাদেশে।
সৌরশক্তির প্রযুক্তি আর ব্যবহারে শীর্ষে রয়েছে ইউরোপ। ইউরোপ ও আমেরিকাকে ছাড়িয়ে শীর্ষে আসার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে চীন। ভারত সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তারা ২০২২ সাল নাগাদ ২০ হাজার মেগাওয়াট সৌরশক্তি চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে। সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের তালিকাতে দেশ হিসেবে শীর্ষে রয়েছে জার্মানি। সম্প্রতি মার্কিন সরকার ক্যালিফোর্নিয়ায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোলার প্যানেল স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে চীন শুরু করেছে সবচেয়ে বড় সোলার প্যানেল বসানোর কাজ।
বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের প্রসারে কাজ করছে যেসব প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের প্রসারে ২০০৩ সাল থেকে কাজ করে আসছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও এনজিও; তাদের মধ্যে ইনস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (ইডকল), গ্রামীণ শক্তি, ব্র্যাক, সৃজনী, ব্রিজ, রুরাল সার্ভিসেস বাংলাদেশ এবং সোনালী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন অন্যতম। এছাড়াও আরও কিছু প্রতিষ্ঠান এলাকাভেদে গ্রামাঞ্চলে সৌরবিদ্যুতের স্থাপনে কাজ করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইডকল সারাদেশে সৌর বিদ্যুৎ প্রসারের জন্য অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে আসছে। বিশ্বব্যাংক ইডকলকে এ খাতে সামগ্রিক অর্থায়ন করে থাকে। ১৫টি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত সাড়ে চার লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করেছে। এছাড়া ইডকল অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক সাহায্য এবং সহজ শর্তে বা কম সুদে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। ২০১২ সালের মধ্যে ১০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের লক্ষ্য আছে তাদের।
বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে সৌর বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্ল্যান্ট (বিডিপি) লি.। স্পেনের সানকো রিনিউয়েবল এনার্জির কারিগরি সহায়তায় এই সৌর প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে আর তা সরাসরি চলে যাচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। এভাবে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে ১০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ।
সোলার প্যানেল বসাতে সরকারি নীতিমালা
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে জানিয়েছেন, ২০১৩ সালের মধ্যে ২৮০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করেছে তাঁর সরকার। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় সোলার প্যানেল বিষয়ক একটি নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়েছে। এই নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২ কিলোওয়াটের বেশি আবাসিক গ্রাহককে তার চাহিদার ৩ শতাংশ সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হবে। একইভাবে বড় ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানের ফ্যান এবং বাতির লোডের ১০ শতাংশ পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা সোলার প্যানেল থেকে ব্যবহার করতে হবে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের। তবে অনেকে সরকারের এই নীতিমালার সমালোচনা করে বলেছেন, যেহেতু সোলার প্যানেল স্থাপন ব্যয়বহুল তাই আইন তৈরি করে সোলার প্যানেল বসাতে বাধ্য করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
অন্যদিকে সৌর বিদ্যুৎ থেকে আরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যে সরকার জানুয়ারি ২০১১ সালে সৌর বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য একটি আলাদা দফতর গঠন করা হবে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে। প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। ‘বাংলাদেশ সোলার হোম সিস্টেম’ শীর্ষক ওই প্রকল্পের অংশ হিসেবে সৌর বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার। ২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান সৌর প্যানেল স্থাপনের জন্য গ্রাহকদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঁচ শতাংশ হারে রিফাইন্যান্স পাবে। আর ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের থেকে সহায়ক রেটে সুদ আদায় করবে। যাতে করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব করা যায়। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন সার্কুলার বা নীতিমালা প্রণীত হয়নি।
সৌরবিদ্যুৎ সহজলভ্য করতে যা করা দরকার
সোলার প্যানেল বসাতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। সাধারণ গ্রাহকের পক্ষে তার জোগান দেয়া সম্ভব হয় না। গত কয়েক বছরে সোলার প্যানেলের দাম কিছুটা কমলেও এখনও তা সাধারণের নাগালের বাইরে। নাভানা রি-নিউয়েবল এনার্জি লি. এর বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী, ২০ ওয়াটের সোলার প্যানেল স্থাপনে খরচ পড়ে ১০ হাজার ৫ শত টাকা এবং ৮৫ ওয়াটে খরচ পড়ে ৩৮ হাজার টাকা। ৮৫ ওয়াটে ৫টি সিএফএল টিউব লাইট এবং একটি সাদাকালো টেলিভিশন চালানো যায়। সোলার প্যানেলের মাধ্যমে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা। সেখানে গ্যাস বা ডিজেলের জেনারেটর বসাতে ব্যয় হয় মাত্র ১০ কোটি টাকারও কম। সৌর প্যানেল বসাতে এত বেশি পরিমাণ অর্থ লাগার কারণ হলো- সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল আমদানি করতে হয়। সোলার প্যানেলের এর ব্যাপক প্রসার এবং স্থানীয় বাজারে এর আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি তৈরির মাধ্যমে এ বিনিয়োগ কমে যেতে পারে অনেকাংশেই। ইতোমধ্যে ইলেকট্রো সোলার নামক একটি দেশীয় কোম্পানি সোলার প্যানেল তৈরি করা শুরু করেছে। এবং দেশীয় আরও কয়েকটি কোম্পানির সোলার প্যানেল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের প্রসার ঘটেছে। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাই সৌর বিদ্যুতকে করতে পারে সহজলভ্য।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এর জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনা ও সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা’কে বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে যে বিদ্যুৎ সংকট তাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার বাড়াতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুতই সবচেয়ে ভাল উপকরণ। সৌর বিদ্যুৎ পরিবেশের কোন ক্ষতি করে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সোলার প্যানেল পরিবেশ এর কোন ক্ষতি করে না। সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করে পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা যায়।’
চিন্তা, ৫ নভেম্বর ২০১০