বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নির্ধারণ: বিতর্কের মূল কারণ গ্যাস উত্তোলন

১.
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি গত দু দশক অবহেলা করা হয়েছে। হঠাৎ করে তা সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন তথা অর্থনৈতিক কারণে এটি জরুরি বিষয় হিসেবে হাজির হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ে দাবি করছে। বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে দু দেশের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। অন্যদিকে সমুদ্রসীমানার মধ্যেই লুকায়িত থাকা বিপুল পরিমাণের তেল-গ্যাসের মত প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। গ্যাস সংকটের কারণে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে এটি দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি আলোচিত বিষয়। অন্যদিকে মিয়ানমার জ্বালানি সরবরাহের পাশাপাশি ভারত ও চীনে গ্যাস রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্র্রার সরবরাহ বাড়াতে চায়। এই বিতর্কে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন কুটনৈতিক আভাস রয়েছে, যাতে ভারত ও চীন তাদের স্বার্থের কারণে গভীরভাবে যুক্ত রয়েছে।

জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের অভাব ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে দু দেশই তেল ও গ্যাস উত্তোলনে সক্ষম হয়নি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশই প্রথম ১৯৭৪ সালে সমুদ্রসীমা আইন প্রণয়ন করে। তারপর ১৯৭৬ সালে মিয়ানমার এবং সর্বশেষ ১৯৭৭ সালে ভারত এ আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এধরনের বিরোধে বিরোধপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে চুক্তিপত্র রয়েছে। কিন্তু ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের এখনো পর্যন্ত কোনো চুক্তি হয়নি। ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার ১৯৮৪ সালেই বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় নিজেদের মধ্যে ২০০ নটিক্যাল পর্যন্ত সমুদ্রসীমানার বিষয়টি মীমাংসা করে ফেলে। একমাত্র বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কখনোই অর্থবহ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বাংলাদেশে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার সমুদ্রসীমা নির্ধারণে যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। ৩৫ বছর ধরে বিপুল সম্পদ সমৃদ্ধ সমুদ্রের জন্য নেই কোনো অধিদফতর। বাংলাদেশ অদ্যাবধি একটি পূর্ণাঙ্গ সমুদ্র গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেনি। সমুদ্রসীমানা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার মতো দক্ষ জনবল সৃষ্টি করা হয়নি।

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সর্বপ্রথম সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমা সম্পর্কিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এর দু দশক পর ২০০৭ সালে পুনরায় দু দেশের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ আলোচনা চলতে থাকে। আলোচনার সফলতা ছিল খুবই কম। কারণ দু দেশই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সম্পর্কিত মৌলিক নীতিমালায় কোন ধরনের ছাড় দিতে রাজি ছিল না। বাংলাদেশ আইনি যৌক্তিকতা হিসেবে সমতার নীতি (চৎরহপরঢ়ষব ড়ভ বয়ঁরঃু) এবং মিয়ানমার সমদূরবর্তী নীতি (চৎরহপরঢ়ষব ড়ভ বয়ঁরফরংঃধহপব) প্রয়োগ করে। অক্টোবর ২০০৮ সালে মিয়ানমারের সিনিয়র ভাইস জেনারেল মং আয়ে (গধঁহম অুব) সমুদ্রসীমা নির্ধারণ বিষয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি ঢাকাকে আশ্বস্ত করেন, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমার সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান করবে না। তাঁর সফরের কিছুদিন পর ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশের দক্ষিণে সেন্ট মার্টিন থেকে ৫০ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ৯৩ কিলোমিটার) দূরত্বে মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দাবিকৃত অঞ্চলে রিগ নিয়ে কোরীয় দাইয়ু কোম্পানির মাধ্যমে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করে। মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিতি এক সংবাদপত্রের সূত্রমতে, ঐ এলাকায় সে সময় দাইয়ু কোম্পানি গভীর অনুসন্ধান ও সাইসমিক সার্ভে (ঝবরংসরপ ঝঁৎাবু) চালায়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হওয়ার আগে জাহাজ সরিয়ে নেয়ার দাবি জানান। মিয়ানমারকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান থেকে বিরত রাখার জন্য বাংলাদেশ সমুদ্রে তিনটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে। এ নিয়ে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হলে কূটনৈতিক এবং সামরিক হস্তক্ষেপে মিয়ানমার রিগ প্রত্যাহার করে নেয়।

১৬-১৭ মে ২০০৯, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি। এর কিছুদিন পর জানুয়ারি ২০০৯ সালে আবার একটি ব্যর্থ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। মে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি সমুদ্রসীমা নির্ধারণ বিষয়ে আলোচনা করতে মিয়ানমান সফরে যান। এটি সে সময় দু দেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়। একই বছরের জুলাই মাসে মিয়ানমারের রাজধানী নাইপিদোতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দু দেশের মধ্যে আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এটিও কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। সর্বশেষ ৮ অক্টোবর ২০০৯ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি সমুদ্রসীমা আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘে সালিশে যাওয়ার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা বিতর্কের মিমাংসায় নতুন করে শক্তি লাভ করে। মিয়ানমার সরকার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও দু দিন পর বাংলাদেশের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে এবং সীমান্তে বেড়া নির্মাণ শুরু করে। এর জবাবে বাংলাদেশও সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে এবং যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে। সে সময়ের ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমার ট্যাংক, কামান, ১২টি যুদ্ধজাহাজ ও রণতরী এবং ৫-৯ ব্যাটালিয়ন পদাতিক বাহিনী মোতায়েন করে। এমনকি মিয়ানমার জঙ্গিবিমানও মোতায়েন করে। এর জবাবে বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও খুলনায় ৩০টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে। পরে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

নভেম্বর ২০০৯ সালে মিয়ানমার বাংলাদেশকে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইবুনাল ফর দ্যা ল অব দ্যা সি’ ((ITLOS) তে বিষয়টি পেশ করার প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশ মিয়ানমারের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেয়। সর্বশেষ ১৪ ডিসেম্বর ২০০৯ সালে প্রস্তাবটি উক্ত ট্রাইবুনালে (ITLOS) পেশ করা হয়। বিলম্বে হলেও জাতিসংঘের সালিশে গেল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকার মনে করছে, (ITLOS) -এর মাধ্যমে সমাধান সম্ভব হলে বর্তমান বিতর্কের অবসান হয়ে একটি আইনি রূপ পাওয়া যাবে। মূলত দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান না হওয়ায় বাংলাদেশ জাতিসংঘে সালিশীতে যেতে বাধ্য হয়েছে।

সমুদ্রসীমা নিয়ে বিতর্ক: বঙ্গোপসাগরে খনিজ সম্পদ প্রাপ্তির সম্ভাবনা
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিতর্কের প্রধান কারণ হলো বঙ্গোপসাগরে জ্বালানি সম্পদ তথা প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সমুদ্রে তেল, গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ আবিষ্কার ও উত্তোলন আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ’। মিয়ানমারের অবস্থাও প্রায় একই রকম। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশের নিকটই সমুদ্রে গ্যাস মজুদের সম্ভাব্য একটা হিসাব রয়েছে। মিয়ানমারের হিসাব অনুযায়ী, ১০-২১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, এর পরিমাণ ৫-১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-তাত্তিক জরিপ ((টঝএঝ) অনুযায়ী, বাংলাদেশের আরও অতিরিক্ত ৩২.১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।

বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি সম্পদ তথা প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ থাকার পরও এটি বিশ্বের সবচেয়ে কম জ্বালানি উৎপাদনকারী অঞ্চল। ভারত ও মিয়ানমার মাত্র কিছুদিন আগে সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করেছে।

বর্তমানে গভীর সমুদ্র থেকেও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের প্রযুক্তির সহজলভ্যতা রয়েছে। সাইসমিক সার্ভের মাধ্যমে এবং রিগ স্থাপন করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উঠানো যায়। এসব প্রযুক্তির উন্নতির কারণে বঙ্গোপসাগরে খনিজ সম্পদ উঠানোর কাজ সহজ হয়ে গেছে। আগে মাত্র ৬০০ মিটার গভীর সমুদ্র থেকে খনিজ তেল ও গ্যাস উত্তোলন করা যেত। এখন গভীর সমুদ্র থেকেও তেল-গ্যাস উঠানো যায়। এরফলে একে কেন্দ্র করে বিনিয়োগ ও ব্যবসা গড়ে ওঠেছে। প্রযুক্তিগত এ উন্নতির ফলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টিও নতুন মাত্রা পেয়েছে।

প্রাকৃতিক গ্যাস উঠানো ও বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রধান উৎস হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। আশি ও নব্বই-এর দশকে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৩.৪% ও  ৪.৯%। ২০০০ সালে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৫.৮%। ২০০৪ সালে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬% ছাড়িয়ে যায়। এ সময়ের মধ্যে শিল্প খাতের প্রসার ঘটে।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মোট বিদ্যুতের ৮৫ ভাগ প্রাকৃতিক গ্যাসের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশ বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি করে ঘাটতি মেটাতে পারছে না বলে দেশের গ্যাসের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু দেশে মজুদ গ্যাস চাহিদা মেটাতে পারছে না। সেপ্টেস্বর ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) এনামুল হক বলেন, ‘২,২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের বীপরীতে বর্তমানে ১,৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাচ্ছে। ফলে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে’। এরফলে একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না, অন্যদিকে কল কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের এখন যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে তাতে ২০২৫ সালে ৫,৬০৬-৭৪৪১ ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন পড়বে। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে বর্তমানে মজুদকৃত গ্যাস ২০১৫ সালের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়েই বাংলাদেশকে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করতে হচ্ছে।

প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন ও মিয়ানমারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি   
মিয়ানমার অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইয়াদানা ও ইয়েটাগুন গ্যাসক্ষেত্র থেকে মাত্র ১০-১৫% (১২৫ মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস ব্যবহার করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাস গুরুত্বপূর্ণ উপাদান না হলেও গ্যাস রফতানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। ২০০৮-৯ অর্থবছরে মিয়ানমার ৩৭৭ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রফতানি করে ১.৯৯৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে। আগস্ট ২০০৯ সালে মিয়ানমারের মোট মাসিক রফতানি আয়ের ৬৬.৫% আসে প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি করে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ (ওগঋ) এর তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের রফতানি আয়ের ৬৬.৫% আসে প্রাকৃতিক গ্যাসের রফতানি আয় থেকে। মিয়ানমারের নতুন রাজধানী নাইপিদো’র যাবতীয় অবকাঠামো নির্মান ব্যয় মিটানো হয়েছে গ্যাস রফতানি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আয় দ্বারা। একই সঙ্গে গ্যাস রফতানি করে প্রাপ্ত অর্থ মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে সহায়তা করেছে। মিয়ানমারের গ্যাস মজুদ থাকার কারণে দেশটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে জাতিসংঘের সমালোচনা থেকে কিছুটা নিরাপত্তা বোধ করছে। এক্ষেত্রে চীন তাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে। অনেকে বলছেন, তার বিনিময়ে চীন মিয়ানমারের সামরিক সরকার থেকে কম দামে গ্যাস ক্রয় করতে পারছে। মিয়ানমারের সরকার গ্যাস রফতানি করে প্রাপ্ত আয় দিয়ে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করে। গ্যাস রফতানি বেড়ে যাওয়ার কারণে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ও বেড়ে গেছে। উদাহরণসরূপ, ডিসেম্বর ২০০৯ সালে ৫৭০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করার চুক্তি করেছে রাশিয়ার সঙ্গে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি পারমাণু বোমা বানানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। চীন কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করছে। এক জরিপে দেখা গেছে, চীন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ৯০% অস্ত্র সরবরাহ করেছে। ভারত গত কয়েক বছর নতুন করে সেখানে অস্ত্র বিক্রি করছে। ভারত ২০০৬ সালে মিয়ানমারকে হেলিকপ্টার, জঙ্গিবিমান, নৌ বাহিনীর সরঞ্জাম ও রাডার সরবরাহের ক্রয়ের জন্য আহ্বান করে। ভারতের এ ধারণা কাজ করেছে যে, এরফলে মিয়ানমার তাদের নিকট গ্যাস বিক্রি করতে উৎসাহী হবে।

মিয়ানমারের বছরভিত্তিক গ্যাস রফতানি আয়ের বিবরণ

বছর    রফতানির পরিমাণ (বিলিয়ন ঘনফুট)    আয়ের পরিমাণ (মিলিয়ন ইউএস ডলার)
২০০৩-০৪    ২০০.০৪    –
২০০৪-০৫    ৩৩৫.৫৩    –
২০০৫-০৬    ৩২২.৭২    ৯৫৯.১৮
২০০৬-০৭    ৪৬০.০৯    ১৭৯৩.৫৮
২০০৭-০৮    ৫১৫.৬৯    ২১৪০.৮৬
২০০৮-০৯    ৩৭৬.৯৭    ১৯৯৬.২৬
২০০৯-১০    ২৯৭.৫৩    ১৫৯৬.৩১

মিয়ানমার বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গ্যাস রফতানি করছে থাইল্যান্ডের নিকট। তবে ভারত ও চীনের নিকট গ্যাস রফতানির জন্য বিভিন্ন চুক্তি সাক্ষর করেছে। মিয়ানমার ভারতের সঙ্গে শিয়ে (ঝযবি) গ্যাসক্ষেত্র থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে গ্যাস রফতানির একটি সমঝোতা চুক্তি সাক্ষর করেছে। কিন্তু ভারত বাংলাদেশকে ট্রানজিট ফি বাবদ বার্ষিক ১০০-১২০ মিলিয়ন ডলার দেয়ার কথা ঘোষণা করলেও এখনো ট্রানজিট সুবিধা পায়নি। ভারতের এই দেরির কারণে মিয়ানমার চীনের সঙ্গে শিয়ে গ্যাসক্ষেত্র থেকে ৬.৫ ট্রিলিয়ন গ্যাস রফতানির জন্য ত্রিশ বছর মেয়াদি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। নভেম্বর ২০০৯ সাল থেকে ‘চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন’ (ঈঘচঈ) মিয়ানমার থেকে গ্যাস আমদানির জন্য একটি পাইপলাইন নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। এটি শিয়ে গ্যাসক্ষেত্র থেকে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমে যুক্ত হবে। ‘মিয়ানমার ওয়েল অ্যান্ড গ্যাস এন্টারপ্রাইজ’ (গঙএঊ) এর মতে, শিয়ে গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রতিবছর ১.৪৬ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চীনে রফতানি করা হবে। পাইপলাইনের মাধ্যমে এইভাবে গ্যাস রফতানি করতে পারলে মিয়ানমার প্রতিবছর ৮০০-৯৬০ মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে। চীনের তীব্র জ্বালানি চাহিদার বীপরীতে সেখানে গ্যাস রফতানি করে মিয়ানমারের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিতর্ক: গ্যাসের ব্যবহার তথা বিদ্যুৎ উৎপাদন
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট নিরসন ও দারিদ্র্যের হার কমানো হবে আগামী নির্বাচনের প্রধান আলোচিত বিষয়। বর্তমান সরকারের এখন অন্যতম লক্ষ্য হলো, সমুদ্র থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো। শিল্পখাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, রাসায়নিক সার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা। গ্যাসের নতুন মুজুদ অনুসন্ধান ও প্রাপ্তি এই সমস্যা মোকাবিলার প্রধান উপায়। এটি বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারেরও অন্যতম প্রধান বিবেচনার বিষয়। দেশটির জন্য বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের একমাত্র উপায় হলো সমুদ্রের গ্যাস উঠানো। এটিই দেশটির জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একমাত্র শেষ উপায়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বঙ্গোসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের কনোকো ফিলিপস ও আইরিশ কোম্পানি তাল্লোকে বঙ্গোপসাগরের ৫, ১০,ও ১১ নং ব্লক তিনটি অনুসন্ধানের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। তবে এ দুটি কোম্পানিকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের ইজারা দেয়ায় বিরোধিতা করে সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালে ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রা জাতীয় কমিটি’ পেট্রোবাংলা ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। তারা নতুন প্রোডাকশান শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (psc) এর বিরোধিতা করে, যেখানে ৮০% গ্যাস রফতানির সুযোগ দেয়া হয়েছে।

২.
সমুদ্রসীমা নির্ধারণ বিতর্কের আইনি দিক
সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দু দেশেরই শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান রয়েছে। এ কারণে দুটি দেশকেই সমুদ্রসীমা বিশেষ করে মহীসোপানের উপর দাবি UNCLOS-এর মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। ১৯৮২ সালের জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা আইন সংক্রান্ত সনদে (UNCLOS-3) সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ের বিশদ ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ২০০১ সালে UNCLOS-3 অনুমোদন করে। UNCLOS-3 অনুমোদনের ১০ বছর পর অর্থাৎ ২০১১ সালের মে পর্যন্ত জাতিসংঘে তাদের দাবি পেশ করার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। মিয়ানমারকে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয় মে ২০০৯ পর্যন্ত। মিয়ানমার ডিসেম্বর ২০০৮ সালে জাতিসংঘের কাছে UNCLOS-3 এর ধারা ৭৬-এর ৮ উপধারা অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে তার মহীসোপানের দাবি দাখিল করেছে। এই দাবিতে মিয়ানমার UNCLOS-3 এর ধারা ৭৬.৩, ৭৬.৪ (এ১, এ২ এবং বি), ৭৬.৫ ও ৭৬.৬ লঙ্ঘন করে ৯২০১৫ দ্রাঘিমা বরাবর বঙ্গোপসাগরে দক্ষিণমুখী খাড়ির পশ্চিমে বাংলাদেশের নদীর পলি দ্বারা গঠিত মহীসোপানের উপর দাবি জানিয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে জাতিসংঘের নিকট মিয়ানমারের এ দাবির বিরোধিতা করে। বাংলাদেশের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ হলো, মিয়ানমারের দাবি সত্য প্রমাণিত হলে সামুদ্রিক সম্পদ, গভীর সমুদ্র এবং মহীসোপানের ওপর তাদের দাবির ন্যায্যতা থাকবে না।

সমস্যা সমাধানে সালিশী এবং দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা ও সালিশী এ দুটি পন্থার মধ্যে সালিশীতে যাওয়াই বাংলাদেশের জন্য শেষ উপায়। বাংলাদেশ ২০০৯ সালের অক্টোবরে মিয়ানমারকে এ বিষয়ে অবহিত করে। মিয়ানমার ৪ নভেম্বর এতে সাড়া দেয়। ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল ফর দ্যা ‘ল’ অব দ্যা সি (ITLOS) এ প্রস্তাবটি পেশ করে। ট্রাইবুনালটি ২১ জন সমুদ্র বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত। এটি সাধারণত খুব দ্রুত রায় দেয়। বাংলাদেশ যদিও সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য জাতিসংঘে গিয়েছে, কিন্তু এরমধ্যেও দু দেশের মধ্যকার আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।

জানুয়ারি ২০১০ সালে দু দেশের মধ্যকার আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। ৮-৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সে বৈঠক শেষে ঘোষণা দেয়া হয়, দু দেশ ন্যায্যতা (Principle of equity) ও সমদূরত্ব নীতি (Principle of equil distance) এর ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে সম্মত হয়েছে। এছাড়া সমুদ্রসীমা নির্ধারণে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। মার্চ ২০১০ সালে এ কমিটির কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হয়। এতে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি দ্রুততর হবে এবং সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনিশ্চয়তা কাটবে। বিরোধ নিষ্পত্তি এখন জাতিসংঘের সালিশ আদালতের পরিবর্তে এখন সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের (ITLOS) মাধ্যমে নিষ্পন্ন করা হবে। মিয়ানমারের অনুরোধের পরিপেক্ষিতে বাংলাদেশ এ পদক্ষেপ নিয়েছে। এই অগ্রগতির ফলে নিজস্ব সমুদ্রসীমা থেকে ২০০ মাইলের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ৩৫০ মাইলের মহীসোপান (Continental shelf) নির্ধারণের পথ সুগম হচ্ছে। এতে মিয়ানমার সমদূরত্ব পদ্ধতিতে তাদের উপকূল সীমানা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল থেকে সর্বোচ্চ ২৪ নটিক্যাল মাইল নিজস্ব সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করবে। আর বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা এর ২০০ নটিক্যাল মাইল নির্ধারণে তারা ন্যায্যতা নীতি মেনে নেবে। এতে ২৪ মাইলের বাইরে ১৭৬ মাইল সমুদ্র এলাকা দু দেশের মধ্যে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভাগ করা হবে।

ITLOS এ সমুদ্রের ‘বেজলাইন (Baseline) বা ভিত্তিরেখা’ নির্ধারণ করাটাই হবে প্রধান সমস্যা। কারণ বেজলাইন থেকেই যাবতীয় সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়। UNCLOS এ দু ধরনের বেজলাইনের কথা বলা হয়েছে, ১. স্বাভাবিক (Normal) ২. সরাসরি (Straight)। বাংলাদেশের ৭২০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় সীমা (Coast line) বিশেষভাবে বৈশিষ্টমণ্ডিত। এটা কেবলমাত্র খাঁজ কাটাই নয়, অসংখ্য ছোট ছোট ক্ষুদ্র দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। অধিকাংশ সময় এই লাইন বরাবর সমুদ্রযান চালনা সম্ভব হয় না। যেহেতু বাংলাদেশের উপকূলের গঠন ভিন্ন ধরনের, তাই বেজলাইন নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। যেখানে ১০ ফেতম (Fathom) বা ৬০ ফুট গভীরতাকে বেজলাইন রূপে ধরা হয়। একই সঙ্গে এই ১০ ফেতম জলসীমাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলসীমা রূপেও গ্রহণ করা হয়।

চিন্তা, ১৫ আগস্ট ২০১০

Leave a Reply

Your email address will not be published.