নিম্নে সফলতা অর্জনকারীদের সাতটি ক্ষমতা তুলে ধরা হলো যা তাদের ব্যর্থ হতে, এরপর সেই ব্যর্থতাকে ব্যক্তিগতভাবে না নিতে এবং সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম করে তোলে:
১. প্রত্যাখ্যানকে প্রত্যাখ্যান করুন
লেখক জেমস অ্যালেন বলেছেন, ‘একজন মানুষ আক্ষরিক অর্থেই তা যা সে ভাবে, তার চরিত্র হচ্ছে তার সকল চিন্তার সম্পূর্ণ যোগফল।’ সেজন্য আপনার চিন্তা-ভাবনা সঠিক পথে চালু আছে কি না তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষের মধ্যে যারা হাল ছেড়ে দেয় না তারা তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। কারণ তারা তাদের কর্মক্ষমতার ক্ষেত্রে স্ব-মূল্যের ওপর ভিত্তি করে চলে না। এর পরিবর্তে, তাদের একটি অভ্যন্তরীণ তথা ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি থাকে। এজন্য তারা ‘আমি একজন ব্যর্থ মানুষ,’ এটা বলার পরিবর্তে বলে, ‘আমি এই সুযোগটি মিস করেছি,’ বা ‘আমি একটি ভুল করেছি।’
মনোবিজ্ঞানী মার্টিন ই. সেলিগম্যান বিশ্বাস করেন, যখন আমরা ব্যর্থ হই, তখন আমাদের দুটি পছন্দ থাকে: আমরা আমাদের ব্যর্থতাকে অভ্যন্তরীণ কিংবা বাহ্যিক করতে পারি। সেলিগম্যান বলেছেন, ‘যারা ব্যর্থ হলে নিজেদের দোষ দেয়, তারা মনে করে তারা মূল্যহীন, প্রতিভাহীন, অপ্রিয়।’ ‘যারা বহিরাগত কারণকে দোষারোপ করে, খারাপ ঘটনাগুলো আঘাত করলে তারা আত্মসম্মান হারায় না।’ অর্থাৎ বিষয়টি হলো সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ধরে রাখা, নিজ কাজের দায়িত্ব নেওয়া, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ব্যর্থতাকে গ্রহণ না করা।
২. ব্যর্থতাকে সাময়িকভাবে মেনে নিন
মানুষের মধ্যে যারা ব্যর্থতাকে ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করে তারা সমস্যাটিকে একটি গর্ত হিসেবে দেখে এবং তারা স্থায়ীভাবে এতে আটকে যায়। কিন্তু সফলতা অর্জনকারীরা যে-কোনো দুর্দশাকে সাময়িক ব্যাপার হিসেবে দেখে থাকে। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান-এর কথা বলা যায়। ১৯২২ সালে তাঁর বয়স ছিল আটত্রিশ বছর। সে সময় তিনি ঋণে জর্জরিত ছিলেন এবং বেকার জীবন-যাপন করছিলেন। অথচ ১৯৪৫ সালে এসে তিনি পুঁজিবাদী বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা বনে যান, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদাবান পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি যদি ব্যর্থতাকে স্থায়ী ব্যাপার হিসেবে দেখতেন, তাহলে তিনি আটকে থাকতেন, কখনই নতুন প্রচেষ্টা চালাতে পারতেন না এবং তার সম্ভাবনার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারতেন না।
৩. ব্যর্থতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখুন
লেখক লিও বুস্কাগ্লিয়া একবার রান্না বিশেষজ্ঞ জুলিয়া চাইল্ডের ব্যাপারে তাঁর প্রশংসা সম্পর্কে কথা বলেছিলেন: “আমি শুধু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে ভালোবাসি। তিনি বলেন, ‘আজ রাতে আমরা একটি সফেল (এক ধরনের কেক) তৈরি করতে যাচ্ছি!’ তারপর তিনি সেটিকে পেশালেন, ঝাঁকুনি দিলেন এবং জিনিসগুলো মেঝেতে ফেলে দিলেন। আর তিনি এসব করলেন বিস্ময়কর মানবিক দক্ষতার মাধ্যমে। এরপর তিনি সফেলটি নিয়ে চুলায় ফেলে দিলেন এবং কিছুক্ষণ অন্যদের সঙ্গে কথা বললেন। অবশেষে, তিনি বললেন, ‘এখন এটা প্রস্তুত!’ কিন্তু তিনি যখন ওভেন খুললেন, তখন সফেলটি অনেকটা ফ্ল্যাট হয়ে একটি প্যানকেকে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তিনি কি আতঙ্কিত বা কান্নায় ফেটে পড়েছিলেন? না! তিনি হেসে বলেন, ‘বিষয়টা হলো, আপনি এগুলোর সব জয় করতে পারবো না। মজা করে খান!”
যখন সফলতা অর্জনকারীরা ব্যর্থ হয়, তখন তারা এটিকে একটি ক্ষণস্থায়ী ঘটনা হিসেবে দেখে, আজীবনের মহামারি আকারে নয়। এটাকে তাদের ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে নেন না। আপনি যদি সফল হতে চান, তাহলে কোনো একক ঘটনাকে আপনার নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে রঙিন হতে দেবেন না।
৪. প্রত্যাশাগুলো বাস্তবসম্মত রাখুন
আপনি যত বড়ো কৃতিত্ব অর্জন করতে চান, বাধা অতিক্রম করা ও দীর্ঘ পথ ধরে অধ্যবসায় করার জন্য তত বেশি আপনার মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন। আপনি যদি আপনার আশেপাশে বেড়াতে যেতে চান, আপনি যুক্তিসঙ্গতভাবে কিছু সমস্যা আশঙ্কা করতে পারেন, যদি থাকে। কিন্তু আপনি যদি মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণ করতে চান, তাহলে ব্যাপার ভিন্ন ধরনের হবে।
মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণ করার জন্য সময় ও প্রচেষ্টা লাগে এবং নানান ধরনের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করার ক্ষমতা থাকতে হয়। আপনাকে যুক্তিসঙ্গত প্রত্যাশা নিয়ে প্রতিদিন যোগাযোগ করতে হবে এবং সবকিছু ঠিকঠাক না হলে আপনার অনুভূতিকে আঘাত করবেন না।
৫. নিজ সামর্থ্যের ওপর মনোনিবেশ (ফোকাস) করুন
সফলতা অর্জনকারীরা ব্যর্থতাকে ব্যক্তিগতকরণ থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখার আরেকটি উপায় অবলম্বন করেন। উপায়টি হলো তাদের নিজেদের সামর্থ্যরে ওপর মনোনিবেশ (ফোকাস) করা। নিউ জার্সি ডেভিলস হকি দলের সাবেক সভাপতি বব বুটেরাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কোন বিষয়টি একজনকে বিজয়ী করে তোলে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বিজয়ীদের থেকে যেটা আলাদা করে তা হলো বিজয়ীরা সর্বদা মনোনিবেশ করে তারা কী করতে পারে, তারা কী করতে পারে না তার ওপর নয়। যদি কেউ একজন দুর্দান্ত শুটার হয়, দুর্দান্ত স্কেটার নয়, তখন আমরা তাকে বলি শুধু শট, শট ও শটের ওপর মনোনিবেশ করতে। ধারণাটি (আইডিয়া) হলো সফলতাকে মনে রাখা।’
যদি কোনো একটি দুর্বলতা আপনার চরিত্রের অংশ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে এক্ষেত্রে অনেক মনোযোগের প্রয়োজন। এর একটি কিনারা না করা পর্যন্ত এর ওপর মনোনিবেশ করুন। অন্যথায়, ব্যর্থতাকে পরাজিত করার জন্য সর্বোত্তম বাজি হলো আপনার সামর্থ্যরে বিকাশ ও সামর্থ্য বৃদ্ধি করা।
৬. সফলতা অর্জনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা
দ্য সাইকোলজি অব অ্যাচিভমেন্টে গ্রন্থে ব্রায়ান ট্রেসি চারজন কোটিপতি সম্পর্কে লিখেছেন যাঁরা তাঁদের পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই নিজ নিজ ভাগ্য (ধন-সম্পদ) তৈরি করেছিলেন। শীর্ষ অবস্থানে যাওয়ার আগে তাদের প্রত্যেকেই গড়ে সতেরোটি ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা চেষ্টা চালিয়ে গেছেন এবং ব্যাবসা পরিবর্তন করেছেন যতক্ষণ না তারা তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য হয় এমন কিছু খুঁজে না পান।
সফলতা অর্জনকারীরা সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য তাদের পদ্ধতির পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। এটা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, শুধু ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে নয়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি ট্র্যাক-অ্যান্ড-ফিল্ড ইভেন্টের অনুরাগী হন, আপনি নিঃসন্দেহে ক্রীড়াবিদদের উচ্চ লাফের প্রতিযোগিতা দেখে তা উপভোগ করেছেন। সেই ইভেন্টে পুরুষ এবং নারীদের দ্বারা অর্জিত উচ্চতা দেখে আমি সবসময় বিস্মিত হই। যা সত্যিই আকর্ষণীয় তা হলো যে ১৯৬০-এর দশকে, এই খেলাটি কৌশলের একটি বড়ো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, যা ক্রীড়াবিদদের পুরানো রেকর্ডগুলো ভেঙে নতুন স্তরে ঠেলে দিতে দেয়।
সেই পরিবর্তন আনয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন ডিক ফসবারি। আগের ক্রীড়াবিদরা উচ্চ লাফের জন্য স্ট্র্যাডল পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন, যেখানে তারা একটি বাহু এবং একটি পা এগিয়ে নিয়ে বারের উপর দিয়ে যেতেন। ফসবারি এমন একটি কৌশল তৈরি করেছিলেন যেখানে তিনি বারে তার পিঠ দিয়ে মাথার উপরে যান। এটিকে ‘ফসবারি ফ্লপ’ বলা হয়।
৭. কাজে ফিরে আসা
সকল সফলতা অর্জনকারীর একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। সেটি হলো ত্রুটি, ভুল বা ব্যর্থতার পরে (হতাশ না হয়ে) কাজে ফিরে যাওয়ার ক্ষমতা। মনোবিজ্ঞানী সিমোন ক্যারুথারস বলেছেন, ‘জীবন হলো ফলাফলের একটি সিরিজ। কখনো কখনো ফলাফল আপনি যেমনটা চান তেমনই হয়। দারুণ ফলাফল। এক্ষেত্রে আপনি ঠিক কী ভালো কাজ করেছেন তা বের করুন। কখনো কখনো আপনি যে ফলাফল চান সেরকম হয় না। এক্ষেত্রে আপনি কী ভুল করেছেন তা খুঁজে বের করুন, যাতে আপনি এটি আর না করেন।” কাজে ফিরে আসার চাবিকাঠি পাওয়া যায় ফলাফলের প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে।
জীবনে যাই ঘটুক না কেন সফলতা অর্জনকারীরা এগিয়ে যেতে সক্ষম। আর এটি সম্ভব হয় কারণ তারা মনে রাখে যে ব্যর্থতা তাদের ব্যর্থ করে না। ভুলকে ব্যক্তিগতভাবে নেওয়া কারো উচিত নয়। ব্যর্থতার পর নিজেকে কাজে ফিরিয়ে আনা ও একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার এটাই সর্বোত্তম উপায়। একবার আপনি এটি করতে পারলে, আপনি সাফল্যের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবেন।
আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে পড়তে পারেন অনুজ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত নেসার আমিন এর অনুবাদকৃত বই “অ্যাটিটিউড ১০১” বইটি। আর্টিকেলটি মূলত এই বইয়েরই নির্বাচিত একটি অংশ। বইটি কিনতে চাইলে ক্লিক করুন রকমারির এই লিঙ্কে ।